আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোন উপায়ে অবাধ ও সুষ্ঠু করা হবে-এ সম্পর্কে বাংলাদেশের কাছে জানতে চাইতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। এক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকেই প্রণয়নের তাগিদ দেওয়ার সম্ভাবনা আএছাড়া গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ১৯৭২ সংশোধন, একজন সচিবের নির্বাচনি প্রচারে অংশ নেওয়া, ঢাকা-১৭ উপনির্বাচনের একজন প্রার্থীর ওপর হামলাসহ সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা সম্পর্কেও প্রশ্ন উত্থাপন করা হতে পারে। পাশাপাশি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন এবং শ্রমিক শহিদুল হত্যার তদন্তসহ মানবাধিকার পরিস্থিতির বিষয়টি স্থান পাবে আলোচনায়।
আসন্ন বাংলাদেশ সফরকালে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে উল্লিখিত বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন আলোচনায় রাজনৈতিক সমঝোতার প্রসঙ্গও আসতে পারে বলে কূটনীতিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার সংক্রান্ত আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ১১ থেকে ১৪ জুলাই বাংলাদেশ সফর করবে। প্রতিনিধিদলে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু এবং ইউএসএআইডির এশিয়া ব্যুরোর ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেটর অঞ্জলি কৌর রয়েছেন।
এদিকে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের এ প্রতিনিধিদলের সফর বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক নয়। তবে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হতে পারে। বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল নির্বাচনের জন্য আসছেন, এটা আমাদের তথ্যের মধ্যে নেই। এখানে অনেক ইস্যু আলোচনা হবে। তার মধ্যে একটা হয়তো থাকবে নির্বাচন নিয়ে, সেটাকে রুল আউট করছি না। এটা যে নির্বাচনকেন্দ্রিক সফর, সেটা ঠিক নয়। মাসুদ বিন মোমেন বলেন, আমেরিকার সঙ্গে আমাদের অনেক ম্যাকানিজম কাজ করছে। লেবার ইস্যু আছে, ট্রেড ইস্যু আছে। এমনকি তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পও পরিদর্শন করবেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সফরের আগে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস তৎপরতা শুরু করেছেন। তিনি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঢাকায় ফিরেছেন। নিয়মিত শলাপরামর্শের জন্য তিনি ওয়াশিংটন গিয়েছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্র ২৪ মে ভিসানীতি ঘোষণা করে। এই নীতির আওতায় কেউ নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় বাধার সৃষ্টি করলে যুক্তরাষ্ট্র তাকে ভিসা দেবে না। ভিসানীতি নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের তরফে বারবারই বলা হচ্ছে, বংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তার লক্ষ্যে এই ভিসানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশের তরফ থেকেও এ ব্যাপারে আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে।
পিটার হাস ঢাকায় ফিরে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এছাড়াও তিনি রাজধানীর বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের কার্যালয়ে গিয়েছিলেন।
সেখানে নিহত শ্রমিক নেতা মো. শহিদুল ইসলামের ইস্যুতে ফেডারেশনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। পিটার হাস বলেন, শহিদুল হত্যার তদন্তের দিকে সতর্ক নজর রাখছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা, এ মামলার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হবে; সেই সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসা হবে। ২৫ জুন রাতে গাজীপুরের বাগানবাড়ি এলাকায় দুর্বৃত্তের হামলায় নিহত হয়েছেন শহিদুল ইসলাম।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের ব্যাপারে কোনো ফর্মুলা দেবে না। বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির ব্যাপারেও যুক্তরাষ্ট্রের কোনো মন্তব্য নেই। তবে ওয়াশিংটনের আগ্রহ, সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে ‘বিশ্বাসযোগ্য’ ও ‘গ্রহণযোগ্য’ উপায়ের প্রতি।
এ ব্যাপারে প্রতিনিধিদলের তরফেও জানার চেষ্টা হতে পারে। জাতীয় সংসদসহ বিভিন্ন পর্যায়ে সরকারি মহলে সুর তোলা হচ্ছে যে বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশে রিজিম চেঞ্জ (ক্ষমতার বদল) করতে চায়। তবে ঢাকায় একটি কূটনৈতিক সূত্র বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের জেদপূর্ণ অবস্থানের কারণ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং ওয়াশিংটনের কৌশলগত স্বার্থ সুরক্ষা। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও খুব স্বল্পসংখ্যক আসন পায়। এ দুটি নির্বাচনের গুণগত মান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রশ্ন তুলেছিল। ওয়াশিংটন হতাশাও ব্যক্ত করেছিল।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন মন্তব্য করেছেন, বাংলাদেশ যেন এমন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করে যাতে গোটা বিশ্ব তাকিয়ে থাকে। বাংলাদেশ সরকারের তরফে বারবার অঙ্গীকার করা হচ্ছে যে, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লন্ডন সফরকালে বলেছেন, বাংলাদেশের নির্বাচন হবে যুক্তরাজ্যের মতো অবাধ ও সুষ্ঠু। কিন্তু কীভাবে করা হবে, সেটাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রশ্ন। নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং বিএনপি তার সহযোগীদের নিয়ে সরকার পতনের একদফা আন্দোলনের ডাক দিতে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও রাজপথে আন্দোলন মোকাবিলার কথা বলছে। ফলে নাটকীয় কোনো ঘটনা না ঘটলে দৃশ্যত সমঝোতার কোনো আভাস মিলছে না। বরং সংঘাতের পথে অগ্রসর হতে পারে দেশ-এমন আশঙ্কা অনেকের।
কূটনৈতিক সূত্রমতে, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনুসন্ধানী মিশন ৯ জুলাই দুই সপ্তাহের জন্য বাংলাদেশে আসছে। তারা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করবে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে সরকারি কর্তৃপক্ষ, নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের সঙ্গে মতবিনিময়ের কথা রয়েছে।
মন্তব্য