প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকার পতনসহ নানা রকম আন্দোলনের ভয়ভীতি দেখাচ্ছে বিএনপি। কিন্তু আওয়ামী লীগকে ওইসব ভয়ভীতি দেখিয়ে কোনো লাভ নেই। কারণ পদে পদে বাধা পেরিয়েই আওয়ামী লীগ এ অবস্থানে এসেছে। শনিবার কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ উদ্বোধন উপলক্ষ্যে আয়োজিত জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
আনোয়ারা উপজেলার কেইপিজেড মাঠে আয়োজিত জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে দেশের উন্নয়ন হয়। আর বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে দেশ ধ্বংস হয়। আমরা দেশের উন্নয়ন করি। বিএনপি-জামায়াত ধ্বংস করে। আগুন দিয়ে জীবন্ত মানুষ পুড়িয়ে মারে। তারা খুনি, জঙ্গিবাদে বিশ্বাসী, ভোটচোর। তাই তাদের হাতে ক্ষমতা যাতে চলে না যায় সে ব্যাপারে জনগণকে সতর্ক থাকতে হবে। বিএনপিকে ভোট চোর আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ভোট চুরি করেছিল বলেই ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে ক্ষমতা থেকে তাদের হটিয়েছিল দেশের জনগণ।শেখ হাসিনা বলেন, নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আপনারা স্বাধীনতা পেয়েছেন। নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে টানেল পেয়েছেন। নৌকা মার্কায় ভোট দিলে দেশের উন্নতি হয়। জনসভায় আগতদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা আমার কাছে ওয়াদা করেন-আগামী নির্বাচনে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে আপনাদের সেবা করার সুযোগ দেবেন। হাত তুলে ওয়াদা করেন। উপস্থিত হাজার হাজার নেতাকর্মী সমস্বরে হ্যাঁ সূচক জবাব দেন। উপস্থিত জনতাকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, আপনাদের জন্য বিশেষ উপহার নিয়ে এসেছি। ‘দইজ্জার তল দিয়ে গাড়ি চলে। অর্থাৎ নদীর তল দিয়ে গাড়ি চলছে। ২০০৮ সালে আপনারা নৌকাকে ভোট দিয়েছেন বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের ২১ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে। ওরা ক্ষমতায় থাকলে খুন করে। দুর্নীতি-লুটপাট করে। চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাকারবারির সঙ্গেও তারা জড়িত। গ্রেনেড হামলা করে আমাকে দিনে-দুপুরে হত্যার চেষ্টা করেছে।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, বিএনপি-জামায়াত যখন ক্ষমতায় ছিল চট্টগ্রাম ছিল সন্ত্রাসের রাজত্ব। সরকারে আসার পর আওয়ামী লীগ শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছে। উন্নয়নের দিকে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা বয়স্ক ভাতা দিচ্ছি। স্বামী পরিত্যক্ত, নিগৃহীত ও বিধবাদের জন্য ভাতা দিয়েছি। বিনা পয়সায় বই দিচ্ছি। বৃত্তি দিচ্ছি। উপবৃত্তি দিচ্ছি। প্রতিবন্ধীদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করছি। তিনি বলেন, ২০০৮ সালে নির্বাচনি ইশতেহারে ঘোষণা দিয়েছিলাম-ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলব। সবার হাতে এখন মোবাইল ফোন। আজ বাংলাদেশ ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপ নিয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করেছি। সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে চট্টগ্রাম থেকে সন্দ্বীপ পর্যন্ত বিদ্যুৎ নিয়েছি। সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। বহুমুখী উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। বেকারত্ব তিন ভাগে নামিয়ে এনেছি। সবার কর্মস্থানের ব্যবস্থা করা হবে।শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা; ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ; নিষেধাজ্ঞা (স্যাংশন) ও পালটা নিষেধাজ্ঞা (পালটা স্যাংশন)। নানা কারণে সমগ্র বিশ্বে জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। আর এ কারণেই ১ কোটি মানুষকে পারিবারিক কার্ড দিচ্ছি। এর মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষ চাল ডাল তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারছে। যারা একেবারেই কাজ করতে পারে না তাদের বাসায় ৪০ কেজি করে চাল দিচ্ছি। মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য ব্যবস্থা নিচ্ছি। করোনার সময় বিনামূল্যে টিকার ব্যবস্থা করেছি। যাতে দেশের মানুষ সুরক্ষিত থাকে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন হয়েছে। গ্রাম-পর্যায়ে পর্যন্ত উন্নয়ন হয়েছে। আওয়ামী লীগ যে কাজ করেছে-সে কাজ অতীতে কোনো সরকার করেনি। বিএনপির কাজ হলো-মানুষ খুন করা, লুটপাট করা, দুর্নীতি করা। খালেদা জিয়া এতিমের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। তার ছেলে তারেক রহমান ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে মুচলেকা দিয়ে দেশ থেকে ভেগে গেছে। কোটি কোটি টাকা মানিলন্ডারিং করেছে। চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র পাচারেও সে জড়িত। এ কারণে দণ্ডপ্রাপ্ত। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে সে আমাকে হত্যার চেষ্টা করেছে। এ মামলায়ও সে সাজাপ্রাপ্ত।
শেখ হাসিনা বলেন, আমার পরিবারের সদস্যদের জিয়াউর রহমান হত্যা করেছেন। এ হত্যার বিচার না করতে জিয়া ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন। আমার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করার পর আমরা দুই বোন বেঁচে ছিলাম। দেশে আসতে দেওয়া হয়নি। অনেকটা জোর করে দেশে ফিরে আসি। জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করাই আমার লক্ষ্য। চট্টগ্রামের প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা এমএ আজিজ, এমএ হান্নান, পুলিন দে, আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবুকে স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে চট্টগ্রামের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এমএ আজিজ কাকা ১৯৬২ সালে বলেছিলেন, আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে থাকব না। টাইগারপাস থেকেই যুদ্ধ শুরু করব। পরবর্তীতে তাই হয়েছিল।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল উদ্বোধন প্রসঙ্গ তুলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, নদীতে সেতু করলে পলি পড়ে। এ কারণে টানেল করেছি। এ টানেল আঞ্চলিক যোগাযোগে যেমন ভূমিকা রাখবে তেমনি এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে এটি যুক্ত হবে। ২০১৫ সালে চীনের প্রেসিডেন্টকে বলেছিলাম টানেল করার জন্য। তিনি রাজি হয়েছিলেন। আজ সে টানেল বাস্তবায়ন হয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার ও ঢাকায় যেতে সময় কম লাগবে। প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত সেতুমন্ত্রী, সেতু বিভাগ, আন্তর্জাতিক পরামর্শক, শ্রমিকসহ যারাই দিনরাত শ্রম করেছেন তাদের সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। এ সময় তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রামে মীরসরাই ইকোনমিক জোন করা হয়েছে। এখানে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসছে।
গহিরায় ৭৪৪ একর জমিতে বিশেষ অর্থনৈতিক জোন হচ্ছে। চট্টগ্রামে চারলেন সড়ক ছয়লেনে উন্নীত করব। ঢাকা-কক্সবাজার হাইওয়ে ছয়লেনে উন্নীত করেছি। চট্টগ্রামে তিনটি মেট্রোরেলের সমীক্ষা চলছে। সম্ভব হলে তাও করে দেব। মীরসরাই থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ পর্যন্ত ২৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে বিশ্বের অন্যতম মেরিন ড্রাইভ হবে। বন্দরে বে টার্মিনাল করছি। নেপাল-ভুটান-ভারতও ব্যবহার করতে পারে। দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন উদ্বোধন হবে শিগগির।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরীর সভাপতিত্বে জনসভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি, সংসদের উপনেতা মতিয়া চৌধুরী এমপি, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী এমপি, মাহবুবউল আলম হানিফ এমপি প্রমুখ। অনুষ্ঠান পরিচলনা করেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ দাশ ও শাহাজাদা মহিউদ্দিন।
এদিকে, শনিবার বেলা পৌনে ১১টার দিকে পতেঙ্গা প্রান্তে উপস্থিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের’ ফলক উন্মোচন করেন। কয়েক মিনিটের আনুষ্ঠানিকতা শেষে তিনি নিজ গাড়ি ও বহর নিয়ে টানেল পার হন। টোল কালেক্টর ঝুমুর আক্তারকে প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে টোল পরিশোধ করেন। প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে টানেল তিনি তিন মিনিটে পার হন। আনোয়ারা প্রান্তে জনসভায় যোগ দিয়ে তিনি বোতাম টিপে টানেলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এ সময় উপস্থিত লক্ষ জনতা হাত তালি দিয়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। পদ্মা সেতুর স্মারক ডাকটিকিট, খাম এবং সুভ্যেনির অবুমক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের ৫০ টাকা মূল্যমানের একটি নোট অবমুক্ত করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের শুভেচ্ছা বার্তা পাঠ করা হয়। সেতু বিভাগের সচিব মনজুর হোসেন বার্তাটি বাংলায় পাঠ করে শোনান। টানেলে অর্থায়নের জন্য চীনা প্রেসিডেন্টকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধন্যবাদ জানান। এ সময় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মো. ফখরুজ্জামান উপস্থিত ছিলেন।
ফখরুলকে লাল কার্ড দেখাতে হবে : জনসভায় সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা ঐকব্যদ্ধ। বিজয়কে আরও সংহত করতে হবে। নেপোলিয়ন বলেছিলেন-বিজয় করেছি সুসংহত করতে পারিনি। আমাদের বিজয় সুসংহত করতে হবে।
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘খেলা হবে, কবে খেলা? চট্টগ্রামে খেলা। ঢাকায়ও খেলা। সব প্রস্তুত। ঢাকায় মির্জা ফখরুল অপশক্তিকে নিয়ে ফাউল করা শুরু করেছেন। লাঠিসোঁটা নিয়ে, রড নিয়ে মাঠে নেমেছে। চালের বস্তা, আটার বস্তা, ডালের বস্তা নিয়ে বিএনপি ৭ নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় থাকার ঘোষণা দিয়েছে। তারা ফাউল করছে। তাদের লাল কার্ড দেখাতে হবে। তাদের সঙ্গে কোনো আপস নয়।
সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ২১ আগস্টে আজকের এ প্রধানমন্ত্রীর বেঁচে থাকার কথা ছিল না। ট্রাকের ঢালায় লেগে যদি গ্রেনেডটা বিস্ফোরিত হতো তাহলে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে আমরা আর পেতাম না। মহান আল্লাহপাক তাকে বাঁচিয়েছেন-এটা আমাদের সৌভাগ্য।গুলিস্তানের মোড়ে পাগল নাচলেও ১০-১২ হাজার লোক হয় : তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, নয়াপল্টনে ৪০-৫০ হাজার লোক জড়ো করে বলছে সরকার ফেলে দেবে। ৫০ হাজার লোকের সমাবেশ করে লাভ নেই, যেখানে গুলিস্তানের মোড়ে অথবা ফার্মগেটে পাগল নাচলেও ১০-২০ হাজার লোক জড়ো হয়। তিনি আরও বলেন, আমরা যখন বিরোধী দলে ছিলাম বিএনপি আমাদের সমাবেশের অনুমতি দেয়নি। তারা (বিএনপি) আমাদের লাঠিপেটা করেছে। মতিয়া চৌধুরীর মতো জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদকে ট্যানাহ্যাঁচড়া করেছে।
হাছান মাহমুদ বলেন, ‘মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগ শুধু রাজনৈতিক দল নয়, আওয়ামী লীগ একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গের নাম। আর আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা, যার শিরায়-ধমনীতে বঙ্গবন্ধুর রক্তস্রোত প্রবহমান, যে রক্ত আপস জানে না, পরাভব মানে না।’
দুর্ভোগ ছিল চরমে : জনসভায় যোগ দিতে এসে নেতাকর্মীদের অনেকে চরম দুর্ভোগে পড়েন। বেলা ১২টার মধ্যেই জনসভার কর্মসূচি শেষ করার কথা ছিল। এ কারণে দূর-দূরান্ত থেকে হাজার হাজার নেতাকর্মী ভোর ৬ টা থেকে সমাবেশস্থলে আসা শুরু করেন। কিন্তু জনসভা শেষ হতে প্রায় ৩টা বেজে যায়। যানজটে অনেক গাড়ি পথে আটকা পড়ে। অনেকে সমাবেশে ঢুকতে না পেরে ফিরে যান। সমাবেশস্থলে বোতল ও চেয়ার ছোড়াছুড়ির ঘটনাও ঘটে।
মন্তব্য