কৌশল বদলাচ্ছে বিএনপি, প্রতিফলন শিগগিরই

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ আগামী ৭ জানুয়ারি। সময় কম, এরই মধ্যে একদফা দাবিতে চলমান আন্দোলন সফলে নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছে বিএনপি। হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে মাঠের কর্মকাণ্ডে কিছুটা সাংগঠনিক দুর্বলতা চিহ্নিত করেছে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। তা কাটিয়ে এখন পুরোপুরি সংগঠিত হয়ে মাঠে নামতেতাই আপাতত হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির পাশাপাশি নির্বাচন বর্জন করা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন দায়িত্বশীল নেতারা। মনোনয়পত্র প্রত্যাহারের শেষ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করে আরও হিসাব-নিকাশ মেলাতে চান তারা। ১৮ ডিসেম্বরের পর আন্দোলনে নতুন মাত্রা পাবে-এমন প্রত্যাশা নেতাদে এছাড়া ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত পেশাজীবীসহ বিভিন্ন ব্যানারে কর্মসূচি পালন করবে বিএনপি। এর মধ্যে ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে ঢাকাসহ জেলা সদরে মানববন্ধন কর্মসূচি রয়েছে। এতে গুম-খুনসহ নির্যাতিত পরিবারের সদস্যদের অংশ নিতে বলা হয়েছে। এদিন ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এ কর্মসূচি পালন করবে। এদিন সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আচরণ দেখে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণার কথা রয়েছে। এছাড়া আজ শাহবাগে ‘গুম-খুন, ক্রসফায়ার বন্ধ করো, মানবাধিকার লঙ্ঘন রুখে দাঁড়াও’ শীর্ষক মানবপ্রাচীর অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে ‘মায়ের ডাক’। একইদিন বিএনপিপন্থি চিকিৎসকদের সংগঠন ড্যাবের ব্যানারেও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন রয়েছে। এছাড়া আত্মগোপনে থাকা নেতারাও মাঠে নামছেন। ১৪ ডিসেম্বর শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে কর্মসূচিতে এসব নেতাকে উপস্থিত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

  নীতিনির্ধারকরা জানান, সামনে সময় কম তা তারাও জানেন। নানা চ্যালেঞ্জ নিয়েই আন্দোলন সফলের দিকে এগোচ্ছেন তারা। এর মধ্যে দলের নেতাকর্মীদের সংগঠিত করে মাঠে নামানো ও নির্বাচন বর্জন করা রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ।

বর্জন করা দলগুলোর প্রধান দাবি হচ্ছে, সরকারের পদত্যাগ। অতীত ইতিহাস বলে, একই দাবি থাকলে তা একমঞ্চে কিংবা ঐক্যবদ্ধভাবে কর্মসূচি পালনের পথেই হাঁটে রাজনৈতিক দলগুলো। এবং তা সফল হয়। সে চেষ্টাই বিএনপি করছে। ইতোমধ্যে অনেক দল ইতিবাচক মনোভাবও পোষণ করেছে। তাদের ধারণা, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষদিনে অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটতে পারে। পাশাপাশি সরকারের ওপর গণতান্ত্রিক বিশ্বের চাপ আরও বাড়বে। সবকিছু বিবেচনায় সরকার দিশেহারা হয়ে পড়ছে। আন্দোলনও তীব্র হবে। দাবি আদায়ে যা যা করা দরকার তাই তারা করবেন। 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান যুগান্তরকে বলেন, ‘দেখুন অবরোধের পেছনে আমাদের মূল বিষয় হলো প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ। প্রথমত, আমরা আওয়ামী লীগের একদলীয় সরকার ও গণতন্ত্র হরণের প্রতিবাদ করছি। দ্বিতীয়ত, শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধ; বিগত এক বছর ধরে বিভাগীয় সমাবেশ থেকে শুরু করে জেলা, উপজেলা এবং ছয় হাজার ইউনিয়নে পদযাত্রা করেছি।

এগুলো সবই ছিল শান্তিপূর্ণ। তাই এখনো শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধের অংশ হিসাবে আমাদের অবরোধ-হরতাল চলছে। অভিযোগ থাকতে পারে বিএনপি হরতাল-অবরোধ করতে পারছে না। এর জবাব হলো-আওয়ামী লীগ যেভাবে লগি-বৈঠা নিয়ে হরতাল করে, বিএনপি তাতে বিশ্বাস করে না। ২০১৪ আর ২০২৪ সাল এক কথা নয়। সমাজে বিবর্তন ঘটেছে। অর্থনৈতিক অবকাঠামো বদলেছে, মানুষের চিন্তাধারায় পরিবর্তন এসেছে। তাই ১৯৫২ কিংবা ১৯৬৯ দূরে থাক, ১৯৯০ সালের আন্দোলনের সঙ্গেও বর্তমান অবস্থা মেলানো সঠিক হবে না।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচনি ট্রেন বিএনপি মিস করেছে নাকি আওয়ামী লীগ মিস করেছে? আগামী নির্বাচন নিয়ে সরকার ইতোমধ্যে হযবরল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। তারা যে পরিকল্পনা নিয়ে নির্বাচনে এসেছিল, এখন তা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সম্পূর্ণ ওলট-পালট করে ফেলেছে। নির্বাচন নিয়ে সরকার তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। মামলা-হামলা, গণগ্রেফতার করেও তারা কিছু অর্জন করতে পারবে না। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনাই এখন আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ।’

বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু বলেন, ‘দলের নেতাকর্মীরা মামলা, হামলা ও গ্রেফতার উপেক্ষা করে কর্মসূচি সফল করছেন। একেকটা সময় একেকটি ডাইমেনশন আসছে। দল ভেঙে নির্বাচনে নিয়ে যাওয়ার সরকার যে অপকৌশল নিয়েছিল তা ব্যর্থ করে দিয়ে সবাই ঐক্যবদ্ধ আছে। সুতরাং আরেকটা ডাইমেনশন সৃষ্টি হবে। সময়ই বলে দেবে কখন সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে কিভাবে আন্দোলন করতে হয়। সেই সময় সব দল-মত, ডান-বাম, ইসলামি, মধ্যপন্থি সবাই এক মোহনায় এসে সরকারের সব ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করে বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে আসবে। সরকারের সব কূটকৌশল পরাস্ত করে আন্দোলনের বিজয় ঘরে তুলবে।’

সূত্রমতে, হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচির সফলতা নিয়ে এখন মূল্যায়ন করছে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। একই সঙ্গে যেসব জেলার নেতাকর্মীরা তুলনামূলক কম মাঠে নেমেছে তাও চিহ্নিত করছে। যাতে করে কোনো ধরনের সমন্বয়হীনতা বা দুর্বলতা না থাকে সেজন্য কোনো কোনো কেন্দ্রীয় নেতাকে ওসব জেলার দায়িত্বও দেওয়া হচ্ছে। তবে কেন্দ্রীয় অনেক নেতার ভূমিকা নিয়ে নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঢাকাসহ অন্তত আটটি জেলার বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশিরভাগ কেন্দ্রীয় নেতাকে ফোন করলেই অন্য কেউ তা ধরে বলছেন, তিনি আত্মগোপনে থেকে সমন্বয়ের দায়িত্বে আছেন। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আসলে ওই নেতা সমন্বয়ের দায়িত্বে নেই। এটি তার মাঠে না নামার একটি কৌশল। অনেকে আবার এক্ষেত্রে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নামও ব্যবহার করছেন। 

জানা গেছে, কর্মসূচি পালনে ঢাকা মহানগর বিএনপিরও দুর্বলতা পেয়েছে দলটির নীতিনির্ধারকরা। ঢাকা মহানগরের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরাই বেশি সক্রিয়। অথচ মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের কেন্দ্রীয় কমিটি ছাড়াও থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়েও কমিটি রয়েছে। কিন্তু তাদের যেমন সক্রিয়ভাবে মাঠে থাকার কথা, তেমনটা দেখা যাচ্ছে না। তবে তা সমাধানে কাজ করছে দলটির হাইকমান্ড। 

স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, ঢাকা মহানগরকে নিয়ে বিশেষ কিছু চিন্তা করা হচ্ছে। কারণ অতীতে তৃণমূলের অভিযোগ ছিল, ঢাকায় আন্দোলন সেভাবে না হওয়ায় সফলতা ঘরে তোলা যায়নি। যদিও এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেভাবে কঠোর, রাস্তায় নামলেই গ্রেফতার করছে, এমনকি গুলিও চালাচ্ছে এমন বাস্তব পরিস্থিতিও তাদের বিবেচনায় রয়েছে। কৌশল বদলে সামনের দিনে ঢাকার আন্দোলন আরও জোরালো করা হচ্ছে। যার প্রতিফলন শিগগিরই দেখা যাবে। 

কাল ঢাকাসহ জেলা সদরে মানববন্ধন : এদিকে কাল বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষ্যে ঢাকাসহ সারা দেশের জেলা সদরে গুম-খুন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মানববন্ধন করবে বিএনপি। এ কর্মসূচি নিয়ে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে দলটি। তবে নির্যাতিত পরিবারের সদস্যদের বেশি জমায়েতের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। শুক্রবার বিকালে ভার্চুয়াল এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘ঢাকা শহরে গুম-খুনের পরিবার এবং যেসব নাগরিক গুম-খুন হয়েছেন সেই পরিবারের সমন্বয়ে মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। ঢাকায় বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন হবে। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর বিএনপি সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। ঢাকার বাইরে অন্যান্য জেলাও মানববন্ধন সফল করার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে। সরকারের দিক থেকে যদি বাধা-বিপত্তি আসে সবকিছুকে প্রতিহত করে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক হিসাবে মানববন্ধন কর্মসূচি সফল করা হবে।’ 

যেসব পরিবার নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়েছে, গুম-খুন হয়েছে সেসব পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মানববন্ধন সফলের জন্য ঢাকাসহ সারা দেশের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীর প্রতি আহ্বানও জানান তিনি।