সারা দেশে চলছে তীব্র গ্যাস সংকট। বাসাবাড়ি, সিএনজি স্টেশন, পেট্রোল পাম্প, শিল্প-কলকারখানা সর্বত্র একই অবস্থা। বিভিন্ন বাসায় সকাল ৭টার পর থেকে দিনভর চুলা জ্বলে না। অনেক এলাকায় মধ্যরাতে হচ্ছে রান্নার কাজ। এ অবস্থায় তিতাসের পাশাপাশি এলপিজি সংযোগও নিতে বাধ্য হচ্ছেন অনেক গ্রাহক। পেট্রোল পাম্পে গ্যাসের চাপ না থাকায় যানবাহনের দীর্ঘ লাইন তৈরি হয়েছে। একটি গাড়ির গ্যাস নিতে কমপক্ষে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা লাগছে। গ্যাস না থাকায় রাস্তার মাঝখানে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অনেক গাড়ি। ফলে রাজধানীতে দেখা দিয়েছে যানজট। গ্যাস সংকট চরমে পৌঁছার অন্যতম প্রধান কারণ হলো চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ব্গ্যাস সংকটের কারণে অনেক শিল্প-কারখানা দিনে বন্ধ রাখতে হচ্ছে। গাজীপুর, সাভার, কোনাবাড়ী, নারায়ণগঞ্জসহ সারা দেশের শিল্পাঞ্চলে চলছে এই সংকট। শিল্পমালিকরা বলছেন, তারা পেট্রোবাংলাকে বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে গেছেন। এখন আর ফোনই ধরে না।
তারা বলছেন, একদিকে ডলার ক্রাইসিস অন্যদিকে গ্যাস সংকট চলতে থাকলে এই সেক্টরে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসবে। বেশ কিছুদিন হলো গ্যাসের সংকট তেমন ছিল না। কিন্তু চলতি মাসের শুরু থেকে সংকট দেখা দিয়েছে। গত এক সপ্তাহ ধরে এই সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। বেশিরভাগ এলাকায় দিনের বেলায় কল-কারখানার উৎপাদন বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৮০০ মিলিয়ন বা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। বিপরীতে সরবরাহ রয়েছে ২৫৫০ মিলিয়ন বা ২৫০ কোটি ঘনফুট। পেট্রোবাংলাসহ জ্বালানি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী গ্যাস সংকটের কারণে ২০২০ সালের এপ্রিলের পর এবারই দেশে গ্যাসের সরবরাহ সর্বনিম্ন। এই সরবরাহ ২০২১ সালের শেষ ছয় মাসের গড় সরবরাহ থেকেও কম। সে সময় ডলারের অভাবে স্পট মার্কেট থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বন্ধ ছিল। এলএনজির দামও তখন ছিল আকাশছোঁয়া। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিদিন মোটামুটি ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ পেলেও বড় ধরনের সংকট হতো না।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, ২০২৬ সালের মধ্যে দেশে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের কাজ চলছে। তবে সম্প্রতি যে সংকট চলছে সেটি কিছুদিনের মধ্যে সমাধান হবে। যদিও খুব তাড়াতাড়ি সংকট সমাধানের কোনো আশা দেখাতে পারেননি তিনি।
মঙ্গলবার সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানি করা গ্যাস সরবরাহে দেশে দুটি রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ) আছে। গত নভেম্বর মাসে একটি ইউনিট সংস্কারের জন্য পাঠানো হয়। যে কারণে গ্যাসের সংকট বেড়েছে। সংস্কার শেষ হওয়ার দুই-একদিনের মধ্যেই ইউনিটটি গ্যাস সরবরাহ শুরু করবে। কিন্তু একই সঙ্গে অন্য একটি এফএসআরইউ সংস্কার কাজের জন্য পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী। আগামী মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এই ইউনিটটির সংস্কারকাজ চলবে। এরপর আগামী রমজান ও বোরো সেচ মৌসুমকে সামনে রেখে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।দুটি ইউনিট চালু থাকলে প্রতিদিন প্রায় ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ হয়। বর্তমানে একটি ইউনিট প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করছে। অর্থাৎ দ্বিতীয় ইউনিটটি চালু হলেও গ্যাস সরবরাহ বাড়ছে না।আবাসিকে গ্যাস সংকটের কথা স্বীকার করছে তিতাস কর্তৃপক্ষ। তাদের দাবি, শীতে সঞ্চালন লাইনে সমস্যার কারণেই এই সংকট। এ মাসের ১৯ তারিখের মধ্যে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস তাদের। তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হারুনুর রশীদ মোল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, এ সমস্যা সাময়িক। আগামী ১৮ বা ১৯ তারিখের মধ্যে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ১৯ তারিখ থেকে গ্যাস সরবরাহ বাড়বে। তখন বর্তমানের মতো এত সমস্যা থাকবে না।পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) মো. কামরুজ্জামান খান বলেন, যে ভাসমান টার্মিনালটি সংস্কারের জন্য বন্ধ ছিল সেটি শিগগিরই চালু হবে। এটি চালু হলে গ্যাসের সরবরাহ কিছুটা বাড়বে। তার মতে, দুটো টার্মিনাল মিলে গ্যাস সরবরাহ করে ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। আর যেটি চলছে, সেটি বর্তমানে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো সরবরাহ করছে।
তবে পেট্রোবাংলার আরেক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, এটি ভাসমান টার্মিনাল বহরে যুক্ত হলেও আরেকটি টার্মিনাল সংস্কারের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। আর একটি যোগ হলেও সর্বোচ্চ ২০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো বাড়বে, যা চাহিদা মেটাতে পর্যাপ্ত নয়। ওই কর্মকর্তা বলেন, মূলত সবচেয়ে বেশি উৎপাদনকারী বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রসহ স্থানীয় ক্ষেত্রগুলোতেও গ্যাসের উৎপাদনও কমে যাওয়ায় এই সংকট তৈরি হয়েছে, যা খুব সহসায় কাটবে না।পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার সাংবাদিকদের বলেছেন, স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে উৎপাদন কমে গেছে। তবে আমরা উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কাজ করছি। আমাদের ২০২৬ সালের মধ্যে প্রায় ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদনের পরিকল্পনা আছে। ইতোমধ্যে আমরা প্রায় ৭০ মিলিয়ন ঘনফুট উৎপাদন করছি। তাৎক্ষণিক এই গ্যাস সংকট মোকাবিলায় এলএনজি আমদানি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই বলেও উল্লেখ করেন জনেন্দ্র নাথ সরকার। তবে বর্তমানে ডলার মজুতের যে অবস্থা, এমন পরিস্থিতিতে সরকারের আমদানি বাড়ানোর সম্ভাবনাও কম।যাপক ফারাক।
মন্তব্য