বাসা পাল্টানো বোধয় পৃথিবীর সবচেয়ে ঝামেলার কাজগুলোর মধ্যে একটি। অন্তত আমার জন্য তাই মনে হয়। বাসার আসবাবপত্র স্থানান্তর বেশ কষ্টের আর বিরক্তিরও বটে। একরকম বাধ্য হয়েই বাসা পাল্টানোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। সারাদিন অফিস করে বাসায় ফিরে বেসুরা গলায় বিরক্তিকর গান বাজনা শুনতে রোজ রোজ কার ভালো লাগে? বাসার পাশে গানের স্কুলের এই যন্ত্রণার কারণেই বাসা পাল্টানোর এই সিদ্ধান্ত।
অবশ্য নতুন বাসাটা বেশ ভালোই লেগেছে আমার। চারতলার একটা বাসার দুতলার একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছি। সবচেয়ে ভালো কথা বেডরুমের পশ্চিম দিকে একটা বিশাল জানালা আছে। যে যন্ত্রণায় এতোদিন শান্তিতে একটু ঘুমাতে পারিনি এবার মনে হয় তা বেশ ভালো ভাবেই পোষিয়ে নেওয়া যাবে। বিশাল জানালায় পশ্চিমা বাতাসে প্রশান্তির ঘুমে এবার আর কেউ বিরক্ত করতে আসবে না।
সারাদিন আসবাবপত্র উঠানো-নামানো আর নতুন বাসা গোছগাছ করে শরীরটা একেবারে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। অবশ্য রাশেদ সাহেব বেশ সহযোগীতা করেছেন। আমি যেখানে বাসা নিয়েছি তার থেকে রাশেদ সাহেবের বাসার দূরত্ব ২০০মিটার বা তার কাছাকাছি হবে। ভদ্রলোকের সাথে আমার পরিচয় বছরখানেক আগে। আমার অফিসে গিয়েছিলেন। আমার সুপারিশেই তার ফাইলটা খালাস হয়েছিল। আমি তখন অফিসের সেকেন্ড অফিসার। এখনও তাই আছি। ভদ্রলোক খুব অনুনয়-বিনয় করে আমার কাছে বললে আমি আর ফিরিয়ে দিতে পারিনি। ফাইলটা যার কাছে ছিল তাকে বলে খালাস করে দিলাম। সেই থেকেই পরিচয়। বাসাটাও তো তিনিই আমাকে দেখিয়ে দিয়েছেন।
সব কাজ শেষ করতে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। দিনের সূর্য ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে দিগন্তের একসারি গাছের আড়ালে। রাশেদ সাহেব আর আমি আমারই বেডরুমে বসে চা খাচ্ছি। সারাদিন পরিশ্রম করার পর ভদ্রলোককে চা’র অফার করতে তিনি আর না করলেন না। চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন-
‘বুঝলেন জনাব, ‘আপনার এই জানালাটা বেশ রোমান্টিক। বিশেষ করে রাতের বেলা’
‘হ্যা, এই জানালা দেখেই তো আমার বাসাটা ভালো লেগেছে। পশ্চিমের জানালা খুলে দিলে ঘর একেবারে শীতল হয়ে যায়। আর জানালার বাইরের পরিবেশটাও চমৎকার। বেশ খোলামেলা। বিস্তীর্ণ এলাকা’, বললাম আমি।
এরই মধ্যে চা শেষ করে উঠতে চাইলেন ভদ্রলোক। আমি অবশ্য রাতের খাবারের অফার করলাম কিন্তু তিনি তা অত্যন্ত ভদ্রতার সহিত প্রত্যাখ্যান করে বিদায় নিলেন। আমিও সারাদিন পরিশ্রম করে শরীর দুর্বল লাগার কারণে একটু তাড়াতাড়িই বিছানায় চলে গেলাম।
সন্ধ্যা ৬টা এখন। আজ অফিসের কাজের ভিষণ চাপ। দুদিন আগে হেড অফিসার স্টোক করার কারণে আমাকে তার স্থানে প্রমোশন দিয়েছে হেড অফিস। তাই সবকিছু নিজের মতো করে গুছিয়ে নিতে আরো আধ ঘন্টার মতো থাকতে হবে অফিসে। বাকি স্টাফরা অবশ্য সবাই চলে গেছে। বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে। অবশ্য আমি সেটা অনুমান করছি মাত্র। কারণ আমার রুমের মানে আমি প্রমোশন পেয়ে হেড অফিসারের যে রুমে অধিষ্টিত হয়েছি সেটার কোন জানালা নেই। ২৪ ঘন্টাই রুমে বাতি জ্বালিয়ে থাকতে হয়। কাজেই দিন কি রাত তা সেই রুমে বসে জানার কোন সুযোগই নেই।
কাজ করতে করতে হঠাৎ ধুপ করে নিভে গেল ঘরের বাতি। আশ্চর্য রকমের এক সুনসান নিরবতা বিরাজ করছে ঘরে। অভেদ্য অন্ধকার যেন আস্ত গিলে নিয়েছে পুরোটা আলো। এমন তো হবার কথা না। অফিসে ইলেকট্রিসিটি একদমই যায় না। আর যদিও বা যায় আইপিএস আছে। তাহলে? কোথাও কি কানেকশনে কোন গন্ডগোল হয়েছে? এই মুহুর্তে এতকিছু না ভেবে ফোনের ফ্লাস জ্বালাতে গিয়ে আমি ব্যর্থ হলাম। মোবাইল অফ। চার্জ নেই একদমই খেয়াল করিনি। তখনই হঠাৎ আমার চোখ আটকে গেল সামনের দরজায়। এতক্ষণ খেয়াল করিনি। অন্ধকারে চোখ সয়ে যেতে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে জিনিসটা। একি এটা তো মোভ করছে। আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। আরো কাছে আসতেই স্পষ্ট হলো অবয়বটা। একটা মানুষের অবয়ব। কিন্তু অফিসে তো এই সময়ে আমি ছাড়া কেউ থাকার কথা না। বুঝতে পারছি আমার শরীর ভিষণ ঘামছে। হঠাৎই অবয়বটা পুরো ঘর কাঁপিয়ে বলে উঠলো-
তুমি জানো না এই চেয়ার আমার? আমি কখনো কাউকে এই চেয়ারে বসতে দেই না।
আরে এ কন্ঠ তো আমার চেনা। এতো আমার হেড অফিসারের গলা। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইলাম। কন্ঠ দিয়ে যেন কথা বের হচ্ছে না। অনেক কষ্টে বললাম-
স্যার আপনি! আপনি তো .....
হ্যা... হ্যা আমি মারা গেছি। কিন্তু তাকে কি? আমি মারা গেলেই কি এই চেয়ারে কাউকে আমি বসতে দিতে পারি? উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলেন হেড অফিসার।
কিন্তু আমাকে তো হেড অফিস থেকে প্রমোশন দিয়ে এই চেয়ারে বসানো হয়েছে, বললাম আমি।
একজন থাকতে আরেকজনকে কিভাবে একই পদে বসাবে? শান্ত গলায় বললেন হেড অফিসার।
আমি এবার খানিকটা সাহস সঞ্চার করে বললাম, কিন্তু আপনি মারা যাবার পর পদ শূণ্য হয়ে যায়। তাই সেই জায়গায় আমাকে প্রমোশন দেওয়া হয়েছে।
তাহলে এই চেয়ার শূণ্য করেই আবার আমাকে বসতে হবে বলে গট গট করে মেঝেতে আওয়াজ তুলে শান্ত পায়ে এগিয়ে এলেন আমার দিকে। একি! হাতে যে মাংস বলে কিছুই নেই। কেবলই হাড়। মুখেরও ঠিক একই হাল। এতক্ষণ খেয়াল করিনি। কঙ্কাল হাতদুটো এগিয়ে আসছে আমার গলা লক্ষ করে। আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা শীতল স্রুত খেলে গেল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইলাম। মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না আর। ঘামে আমার তলদেশ ভিজে গেছে বেশ বুঝতে পারছি। গলা শুকিয়ে আসছে। আর কিছুই ভাবতে পারলাম না আমি। চোখ বন্ধ করে রইলাম। বুঝলাম আজ আমার ইতি হতে যাচ্ছে এই কঙ্কালের হাতে।
ক্রিং ক্রিং.....
ফোনের রিংটনে গড়মড় করে বিছানা থেকে উঠলাম। শরীরের ঘামে বিছানা ভিজে গেছে। গলায় হাত দিয়ে দেখলাম। না, সবকিছু ঠিকই আছে। স্বপ্ন দেখছিলাম আমি। কি ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন ছিল! একেবারে যাচ্ছে তাই।
ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম আমারই অফিসের এক কলিগ কল করেছে। এখন বাজে সকাল সাড়ে ৭টা। কিন্তু এতো সকাল কেন ফোন দেবে? ফোন ধরতে দেরী হওয়ায় কল কেঁটে গেছে। তাই কল ব্যাক করে আমার বিশাল জানালার দিকে এগিয়ে গেলাম। ভোরের প্রকৃতি জানালায় দেখতে মনে হচ্ছে বিশাল ফ্রেমে বাধানো সুনিপুণ শিল্পীর হাতে আঁকা চিত্রকর্ম। মিষ্টি বাতাস মন ভালো করে দেওয়ার মতো। কিন্তু সেটা আর দীর্ঘস্থায়ী হলো না। ফোন ধরতেই জানতে পারলাম- হেড স্যার আর নেই।
দুদিন পরই হেড অফিস থেকে একটা ই-মেইল পেলাম। এই দুদিন ভিষণ অস্বস্থি আর ভয়ে কেঁটেছে আমার। কিন্তু এই মেইলটা যেন ভয়ের মাত্রা আরো ১০০০ মেগাওয়াট বাড়িয়ে দিলো।
Dear Mr Rakib,
Consequent to the review of your performance during the last year, we are pleased. Due to the premature death of Mr. Rafiq, the head officer's post is currently empty. Now we promote you as Head Officer.
We are sure you will make best use of the opportunity offered to you and contribute substantially to the success of our organization as you have done in the past and fully justify the confidence placed in you by the management. A separate communication on the details of your salary revision is being sent to you.
Wishing you all the best.
লেখক: জাকারিয়া মোহাম্মদ
মন্তব্য