দেড় মাস ধরে দেশের বাজারে ‘পেঁয়াজ সংকটের’ অজুহাতে মুনাফাভোগীরা তাদের পকেট ভারি করছে। দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন ও সন্তোষজনক আমদানি পরিস্থিতির পরও ভারতের রফতানি বন্ধে সংকট তৈরি হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে। আর এ সংকটের কথা বলেই আমদানিকারকরা দেশে পেঁয়াজের বাজার অস্থিশীল করে রেখেছেন।
ভারত থেকে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ থাকলেও বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজের চালান দেশের বাজারে নিয়মিত ঢুকছে। কিন্তু আমদানিকারকরা এসব পেঁয়াজ সীমান্ত পার করে দেশে এনেই এলসি মূল্যের দ্বিগুণ দামে পাইকারদের কাছে বিক্রি করছে। পাইকাররা আবার খুচরা বিক্রেতাদের কাছে এক ধাপ বাড়িয়ে বিক্রি করছেন।
ফলে বাজারে ভোক্তা পর্যায়ে আসতে পণ্যটির দাম আরও এক ধাপ বেড়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে একশ্রেণির মুনাফাভোগী ক্রেতাদের পকেট কাটছে। পেঁয়াজ কিনতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন ভোক্তারা।
রাজধানীর শ্যামবাজার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও খাতুনগঞ্জের পেঁয়াজ আমদানিকারদের সঙ্গে বৃহস্পতিবার কথা বলে জানা গেছে, দেশের বাজারে মিসরের পেঁয়াজের আমদানিমূল্য কেজিপ্রতি ৪০-৪৫ টাকা। কিন্তু সংকটের কথা বলে আমদানিকারকরা কমিশনভোগী বিক্রেতাদের মাধ্যমে পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে কেজিতে ৫৫ টাকা লাভ করছেন। তারা দাম নিচ্ছেন ৯৫ টাকা। পাইকারি বিক্রেতারা খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছেন ১০০-১০৫ টাকা কেজি। খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে ভোক্তারা কিনছেন ১৩০ টাকায়।
প্রতি কেজি মিয়ানমানের পেঁয়াজের এলসি মূল্য ৬৮ টাকা। পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে ১০০ টাকা। পাইকারি বিক্রেতারা এই পেঁয়াজ খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছে ১২০ টাকা। খুচরা বিক্রেতারা ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রি করছে ১৩০ টাকা কেজি দরে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারতীয় পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের আগে ভারতীয় পেঁয়াজের আমদানিমূল্য ছিল প্রতি কেজি ৭৫ টাকা। আমদানিকারকরা কমিশন বিক্রেতাদের মাধ্যমে পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে প্রতি কেজি ভারতীয় পেঁয়াজ ৫০ টাকা লাভে বিক্রি করছে ১২৫ টাকা। পাইকারি বিক্রেতারা খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছে ১৩৪-১৩৫ টাকা। খুচরা বিক্রেতারা ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রি করছে ১৪০ টাকা।
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে- মিসর, মিয়ানমার কিংবা ভারতের আমদানি করা পেঁয়াজ সীমান্ত পেরিয়ে দেশে আসার সময়ই দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়।
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী মো. আমানত আলী বলেন, আমরা কমিশনে বিক্রি করি। বাজার নিয়ন্ত্রণ করে আমদানিকারকরা। তারা যে রেট (দর) দেয় সেই দামে আমাদের বিক্রি করতে হয়। তাই বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে আমদানিকারকদের প্রতি নজর দিতে হবে।
এদিকে বৃহস্পতিবার কৃষক পর্যায় থেকে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১০০ টাকা কেজি দরে। কিন্তু মোকাম মালিকরা পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে এ পেঁয়াজ বিক্রি করছে ১২৫ টাকা। পাইকাররা খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছে ১৩৫ টাকা। আর খুচরা বিক্রেতারা ভোক্তার কাছে বিক্রি করছে ১৪০ টাকা কেজি।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের ৪১নং আড়তের ব্যবসায়ী মো. মনির হোসেন বলেন, আমরা বাড়তি দরে কিনে ৫-১০ টাকা খরচ রেখে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে দেই। যা দাম বাড়ানোর আমদানিকারকরাই বাড়িয়েছে। সংকটের কথা বলে যে যেভাবে পারছে লাভ রেখে বিক্রি করছে।
তিনি আরও বলেন, শুধু যে আমদানিকারকদের দোষ সেটাও না। পাইকারি ও খুচরা দরে দেখা যাবে, বিক্রেতারা সুযোগ বুঝে কেনা দামের চেয়ে অনেক বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি করছে।
কারওয়ান বাজারের খুচরা বিক্রেতা মো. আল আমিন বলেন, সবাই বলছে পেঁয়াজের সংকট। কিন্তু কোথায় সংকট তা দেখছি না। সংকটের কথা সবাই বলছে, আমিও বলছি। দামও বাড়তি নিচ্ছি। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে দাম বাড়তি হলেও ক্রেতারা চাহিদা অনুযায়ী পেঁয়াজ পাচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, যারা সবচেয়ে বেশি দাম বাড়ায়, তাদের না ধরে তদারকি সংশ্লিষ্টরা আমাদের ধরে। মূল্য তালিকা না থাকলে জরিমানা করে। মূল্য তালিকা টানালে আমি তো বেশি দামই লিখব। সেটা তাদের বুঝতে হবে। তবে সার্বিক দাম কমাতে হলে আমদানিকারকদের নজরদারিতে আনতে হবে।
শ্যামবাজারের পেঁয়াজ আমদানিকারক শঙ্কর চন্দ্র ঘোষ বলেন, বাজারে পেঁয়াজের সংকট আছে। যে কারণে দাম বাড়তি। কারণ আগে যে পরিমাণে পেঁয়াজ আসত, সে অনুপাতে আসছে না। তবে কিছুদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে আসবে। এলসি মূল্যের প্রায় দ্বিগুণ দামে পাইকারদের কাছে বিক্রির প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেশে এখন পেঁয়াজের সংকট চলছে। তাই যে যেভাবে পারছে পণ্য আমদানি করে বেশি দামে বিক্রি করছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের মেসার্স বিএইচ ট্রেডিং অ্যান্ড কোম্পানির মালিক পেঁয়াজ আমদানিকারক মো. বাবুল হাসনাত যুগান্তরকে বলেন, দেশে পেঁয়াজের সংকট আছে। কারণ ভোমরা স্থলবন্দর, সোনামসজিদ স্থলবন্দর ও হিলি স্থলবন্দর দিয়ে এখনও পেঁয়াজ আসছে। যেখানে প্রতিদিন ৩০০-৪০০ ট্রাক পেঁয়াজ আসত, সেখানে কোনোদিন ১০০ ট্রাক, আবার কোনো দিন দেড়শ’ ট্রাক পেঁয়াজ আসছে।
এলসি মূল্যের চেয়ে দ্বিগুণ মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক সময় এলসি মূল্যের চেয়ে পেঁয়াজ আমাদের বাড়িয়ে বিক্রি করতে হয়। কারণ আমরা যখন পেঁয়াজ আমদানি করি তখন দেশের বাজারে আনতে অনেক পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। তখন এই নষ্ট পেঁয়াজের মূল্য ধরে আমাদের বিক্রি করতে হয়। যদি এটা না করি, তাহলে আমাদের লোকসান গুনতে হবে। তবে কয়েকদিনের মধ্যে আরও পেঁয়াজ দেশের বাজারে আসবে। তখন সংকট না কাটলেও দাম কিছুটা কমে আসবে।
কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ড. গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, দেশে পেঁয়াজের সংকট কোথায় সেটা বোঝা যাচ্ছে না। কারণ বাজারে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। ভোক্তা তার চাহিদামতোই পেঁয়াজ কিনতে পারছে। এমন তো হচ্ছে না, বাজারে পেঁয়াজই নেই! তবে কেন দাম এত চড়া?
ভারত থেকে রফতানি বন্ধের অজুহাত কাজে লাগিয়ে একটি মহল সুপরিকল্পিত কারসাজি করে পণ্যটির দাম বাড়িয়েছে। তারা ‘সংকটের’ কথা বলে ইতিমধ্যে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এতকিছুর পরও সংশ্লিষ্ট বাজার তদারকি সংস্থা দোষীদের শাস্তির আওতায় আনতে ব্যর্থ হচ্ছে। এতে সরকারের ভাবমূর্তিও নষ্ট হচ্ছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান- বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক ড. এমকে মুজেরি যুগান্তরকে বলেন, যে কোনো ব্যক্তিগোষ্ঠীর হাতে বাজারের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা চলে গেলে ভোক্তার স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়। তাই ভোক্তার সুরক্ষা দিতে হলে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের দরকার প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করে দেয়া। কিন্তু দেশে সেটি হচ্ছে না। কিছু ব্যক্তি-গোষ্ঠীর হাতেই নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। এরা কারসাজি করলে সরকারের আর করার কিছু থাকে না।
তিনি আরও বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতি থাকবে। কিন্তু তার মানে এ নয়, এর মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা যা খুশি তাই করার সুযোগ পাবে। বিশ্বের অনেক দেশে মুক্তবাজার অর্থনীতি থাকলেও সরকারের হাতে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকে। বাংলাদেশেও এ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রাখতে হবে। এর জন্য দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর মনিটরিং সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণের কার্যকর সুফল পেতে টিসিবির সক্ষমতাও বাড়ানো জরুরি। তা না হলে ভোক্তার স্বার্থ রক্ষা করা দুরূহ ব্যাপার বলেই মনে হচ্ছে।
এদিকে বৃহস্পতিবার রাজধানীতে একটি অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, দেশে যাতে পেঁয়াজ নিয়ে আর সংকট না হয়, এ জন্য আগে থেকেই ব্যবস্থা নেয়া হবে। কয়েকদিনের মধ্যে ভারত যদি পেঁয়াজ রফতানি নাও করে, তারপরও এ মাসের শেষের দিকে দেশে উৎপাদিত নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসতে শুরু করবে। তখন দাম ক্রেতার নাগালে চলে আসবে। এ সময় তিনি আরও বলেন, দেশে পেঁয়াজের মৌসুমে পণ্যটি আমদানি না করার কথা ভাবছে সরকার। এতে করে কৃষক লাভবান হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার যুগান্তরকে বলেন, দেশের পেঁয়াজের বাজারে এখন নৈরাজ্য চলছে এটা সত্য। তবে এ বিষয়ে অধিদফতরও বসে নেই। প্রতিদিন পেঁয়াজের বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে। ভোক্তা স্বার্থে যখন যেখানে অনিয়ম পাওয়া যাচ্ছে, শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে। বড় ব্যবসায়ীরা নজরদারির মধ্যে আছে। তদারকির মাধ্যমে অনিয়ম বের হয়ে এলে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ২৪ লাখ টন। গত মৌসুমে ২৩ লাখ ৩০ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৭ লাখ টন নষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ২২ লাখ টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই পর্যন্ত দেশে এক লাখ টনের বেশি পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকও বলছে, দেশে বর্তমানে পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি নেই। সূত্র আরও বলছে, ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করার পর ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে মিয়ানমার থেকে ১২ হাজার ৮৪৯ টন, ভারত থেকে ৮ হাজার ৫৬৮ টন (নিষেধাজ্ঞার আগে এসব পেঁয়াজের ঋণপত্র খোলা হয়েছিল), মিসর থেকে ৫৬২ টন ও চীন থেকে ৫২ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়- দেশে বর্তমানে পেঁয়াজের তেমন কোনো সংকট নেই।
মন্তব্য