করোনা মহামারীতে গেমসে আটকে গেছে শিশুদের জীবন

সারাবিশ্বে করোনাভাইরাসের মহামারীতে থমকে গেছে মানুষের ব্যস্তময় জীবন এবং ক্ষতিগ্রস্ত সকল কর্মকাণ্ড। তেমনি বাংলাদেশও থমকে গেছে। দিন দিন আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ায় কঠোর আইনের দিকে যাচ্ছে সরকার। ইতিমধ্যে দেশের অনেক জেলা লকডাউন করা হয়েছে। এছাড়াও দেশের প্রতি জেলায় বহু বাসা লকডাউন করা হয়েছে। সেইসঙ্গে আটকে গেছে শিক্ষার্থীদের জীবন। গত ১৬ মার্চ মন্ত্রীসভার এক সিদ্ধান্তে পর ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রাখা হয় প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টারসহ সকল ধরনের প্রতিষ্ঠান। প্রথমে ৩১ মার্চ পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা হলেও পরে সেটি সময় বাড়িয়ে দেয়া হয়। একই সঙ্গে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরুর তারিখও স্থগিত করা হয়। বন্ধের এই সময়ে শিক্ষার্থীদের বাড়িতে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ফলে প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী অনেকটা ঘরবন্দী অবস্থায় আছে। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থী পৌনে দুই কোটির মতো। আর মাধ্যমিকে শিক্ষার্থী এক কোটির ওপরে। একদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, অন্যদিকে কোচিং বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ওপর প্রভাব পড়ছে। এমতবস্থায় শিক্ষার্থীরা বাসায় বন্ধী জীবন কাটাচ্ছে। যেখানে শিশু শিক্ষার্থীরা ভোর থেকে পড়াশোনার ব্যস্ত হয়ে পড়তো এবং প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতো সেখানে এখন মিলছে ভিন্ন চিত্র। বিদ্যালয়ের কথা ভুলে গিয়ে এখন তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ছে প্রযুক্তি গেমস নিয়ে। সাধারণত বাচ্চারা পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলায় মগ্ন থাকতে ভালোবাসে। কিন্তু এ সময়টিতে বাইরে যেতে বাধা হওয়ায় তারা প্রযুক্তি গেমসকে বেঁছে নিয়েছে। অনেক অভিভাবকরা ইচ্ছা করেই হাতে তুলে দিচ্ছেন এ গেইমসে। ঘরে রাখার জন্যই তারা এ উপায় অবলম্বন করছেন। এতে শিক্ষার্থীরা একঘেয়েমি হয়ে পড়ছেন। এ বিষয়ে কয়েকজন শিক্ষাবিদদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, ডিজিটাল গেমস শিশুদের ওপর মানসিক, শারীরিক ও সামাজিক প্রভাব ফেলে। এক্ষেত্রে মায়েদের বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে। শিশুদেরকে বেশি বেশি গল্প শোনাতে হবে। চিত্রকলা, গান, নাচ প্রভৃতির সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। পর্যাপ্ত সময় দেয়া এবং তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ হয় এমন খেলাধুলায় ব্যস্ত রাখা গেলে প্রযুক্তি আসক্তি অনেকটাই কমানো সম্ভব বলে মনে করছেন তারা। মা মানেই হচ্ছেন শিশুদের শিক্ষক, ডাক্তার ও দেখাশোনার জন্য দায়িত্বশীল একজন অভিভাবক। কথা বলছিলাম এমন ভোলার দু'জন নারী অভিভাবকের সঙ্গে। তাদের একজন সাবেক বেসরকারি টেলিভিশনের অনুষ্ঠান উপস্থাপক লিপি, আরেকজন শিক্ষক রাজিয়া সুলতানা (শিল্পী)। লিপি। বর্তমানে তিনি একজন গৃহিনী। তার দুই সন্তান। এক মেয়ে ও এক ছেলে। মেয়ের নাম রোজ আর ছেলের নাম ঋজু। রোজ ভোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী ও ঋজু ভোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। পরিবারের বাবা একজন সরকারি চাকরিজীবী। তিনি বর্তমানে মিশনে কর্মরত আছেন। সেই সুবাদে পরিবারের সকল দায়িত্ব এখন লিপির ওপর। ছেলে-মেয়েদের দায়িত্ব ও সংসারের সকল কিছু তিনি একাই সামলান। তবে করোনায় তাকে একটু বেশি দায়িত্বের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। তিনি বলেন, আগে সকাল হলেই বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে যেতাম এবং স্কুল শেষে আবার বাসায় নিয়ে আসতাম। বাকি সময়টা বাচ্চারা প্রাইভেট টিচার আর কোচিং নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। আমি তখন শুধু ওদের মনিটরিং করলেই চলতো। কিন্তু এখন মহামারী করোনাভাইরাসের জন্য সকল কিছু বন্ধ করে দেওয়ায় বাচ্চাদের দায়িত্ব নিতে হয়েছে। আমার মেয়েটা কিছুটা কথা শুনলেও ছেলেটা একেবারেই নাছোড়বান্দা। তেমন কোন কথা শুনতেই চায় না। ঋজু এখন পড়াশোনার চেয়ে বেশি আসক্ত হয়ে পড়েছে প্রযুক্তি গেমসের ওপর। এতে যদি ছেলেকে বাধা দেওয়া হয় তখন তার হাজারটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ছেলের প্রশ্ন হলো আর কতদিন এভাবে বাসায় থাকবো। আগে বিকেলে সাইকেল চালাতাম এখন তাও দাও না। বাইরে গেলে মাস্ক পড়তে হচ্ছে, হাতে হ্যান্ডস্যানিটাইজার ব্যবহার করা লাগছে। এভাবে আর ভালো লাগে না। তাই বাচ্চাদের স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে বাধ্য হয়ে প্রযুক্তি গেমস ব্যবহারের সিদ্ধান্ত বহাল রেখেছি। অন্যদিকে এমনই এক নারী অভিভাবক রাজিয়া সুলতানা (শিল্পী)। তারও দু'সন্তান। বড় মেয়ে অর্থি দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আর ছোট ছেলে মুহাইমিন চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। পরিবারের বাবা মো. হুমায়ুন কবির একজন কলেজ প্রভাষক। শিল্পী একজন অদম্য নারী। তিনি শিক্ষকতা পেশা যথাযথ পালন করার পাশাপাশি পরিবারের রান্নাবান্না, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, হাতের কাজ এবং শিক্ষক সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। করোনা মহামারীতে তার চলমান জীবন এখন আটকে পড়ছে। তিনি বলেন, বাসায় বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে সন্তানকে সামলানো। ছেলে মুহাইমিন এমনিতেই প্রযুক্তি গেমসে আসক্ত। বাসার বাইরে যাওয়া বাঁধা দেওয়ায় সে এখন এটাকে প্রধান কাজ হিসেবে বেঁছে নিয়েছে। কোনো কিছুতেই এ থেকে তাকে সরানো যাচ্ছে না। বাধা দিলে হয়তো বাসা থেকে বের হওয়ার হুমকি দেয় আর না হয় বোনের সঙ্গে ঝগড়া শুরু করে দেয়। তাই নীরবে এখন চেয়ে যাচ্ছি। তবে এ সমস্যা শুধু লিপি আর শিল্পীর নয়। এ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন প্রতিটি পরিবারের অভিভাবকরা। এ সমস্যা থেকে বের হয়ে আসতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সময়টিতে শিশুদেরকে বেশি বেশি গল্প শোনাতে হবে। চিত্রকলা, গান, নাচ প্রভৃতির সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। পর্যাপ্ত সময় দেয়া এবং তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ হয় এমন খেলাধুলায় ব্যস্ত রাখা গেলে প্রযুক্তি আসক্তি অনেকটাই কমানো সম্ভব বলে মনে করছেন তারা।