করোনার মহামারীতে বিশ্বব্যাপী রেমিটেন্স ধসের কারণে তিন ধরনের ঝুঁকিতে পড়েছে দেশে প্রবাসীদের এক কোটি পরিবার। প্রবাসে চাকরিচ্যুত ও মজুরি কমে যাওয়ায় অর্থ সংকটের মুখে পড়ে দরিদ্র হবে অনেক পরিবার। রেমিটেন্স প্রবাহ হ্রাসে সন্তানদের শিক্ষা খাতে ব্যয় বন্ধের উপক্রম হবে। সর্বশেষ পরিবারে শিশুশ্রম বৃদ্ধির শঙ্কাও আছে। প্রবাসীদের পরিবার নিয়ে এমন শঙ্কা বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে ওঠে এসেছে। প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দিয়ে বলা হয়েছে- করোনার প্রভাবে ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী রেমিটেন্স ২০ শতাংশ হ্রাস পাবে। আর বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়াতে এর মাত্রা হবে আরও বেশি। সম্প্রতি ‘ডিকলাইন অব রেমিটেন্স ইন রিসেন্ট হিস্ট্ররি’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। রেমিটেন্স প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিট ম্যালপাস বলেন, আগামী ২০২১ সালে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো রেমিটেন্স ধসে কিছুটা উত্তরণ ঘটাতে পারবে। আশা করা যায়, সে বছর রেমিটেন্স প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে। চলতি বছরের রেমিটেন্স পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের আভাস সম্পর্কে জানতে চাইলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান যুগান্তরকে বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের মূল্য অস্বাভাবিক কমেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে তেলনির্ভর অর্থনীতির দেশগুলোর ওপর। যে কারণে ওই দেশ চাকরি থেকে কর্মী ছাঁটাই ও মজুরি কমিয়ে দিচ্ছে। আমাদের অনেক প্রবাসী এসবের শিকার হচ্ছেন। এর প্রভাব গিয়ে পড়ছে রেমিটেন্সের ওপর। তারা রেমিটেন্স পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন সরকারকে এদিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। ফেরত আসা প্রবাসীদের বিশেষ প্রণোদনার আওতায় আনতে হবে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনায় বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টি হয়েছে। যে কারণে বিশ্বব্যাপী রেমিটেন্স ধসের ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। এতে প্রবাসীদের মজুরি কমছে, চাকরিচ্যুত হচ্ছেন অনেকে। সেখানে আরও বলা হয়, ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী ৫৫ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলারের রেমিটেন্স পাওয়া গেছে। কিন্তু ২০২০ সালে করনোর কারণে তা কমে ৪৪ হাজার ৫০০ কোটি মার্কিন ডলারে নেমে আসবে। অর্থাৎ করোনার মহামারী রেমিটেন্স খেয়ে ফেলবে ১০ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে রেমিটেন্স কমবে ১৯ দশমিক ৭ শতাংশ। আর বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় কমবে ২২ দশমিক ১ শতাংশ। যেখানে ২০১৯ সালে প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ১ শতাংশ। এছাড়া ইউরোপ ও মধ্য এশীয়ায় হ্রাস পাবে ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ, আফ্রিকায় ২৩ দশমিক ১ শতাংশ, মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৯ দশমিক ৬ শতাংশ, লাতিন আমেরিকায় ১৯ দশমিক ৩ শতাংশ এবং পূর্ব এশিয়া ও প্যাসিফিকে কমবে ১৩ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, রেমিটেন্স নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে দারিদ্র্যবিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। অনগ্রসর পরিবারগুলোতে উন্নত ব্যয়ের সক্ষমতা তৈরি করেছে। পাশাপাশি প্রবাসীদের পরিবারে সন্তানদের শিক্ষার পেছনে ব্যয়ে সক্ষমতা বেড়েছে এবং পরিবারের শিশুশ্রম নিরসণে ভূমিকা রাখছে। এখন নতুন করে এসব বিষয় ফিরে আসা নিয়ে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। জানা গেছে, পৃথিবীর ১৬৯টি দেশে বাংলাদেশের এক কোটিরও বেশি মানুষ কাজ করেন। এর মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশের কর্মসংস্থান মধ্যপ্রাচ্যে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশিরা একদিকে বেতন পাচ্ছেন না, অন্যদিকে অনেকে ছাঁটাই এবং মজুরি হ্রাসের কবলে পড়েছেন। ফলে প্রবাসীদের অনেকেই এখন বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারছেন না। চাকরি নিয়েও আছে দুশ্চিন্তা। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে থাকা প্রবাসীদের পরিবারগুলোতে আর্থিক সংকট দেখা দিচ্ছে। কথা বলে বোঝা যাচ্ছে, অনেকেই সংকটে পড়ে গেছেন। বিদেশ যাওয়া বন্ধ, আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে এসে কর্মস্থলে ফেরা নিয়েও অনিশ্চয়তায় প্রায় দুই লাখ প্রবাসী। প্রবাসীদের পরিবার নিয়ে বিশ্বব্যাংক যে তিনটি ঝুঁকির আশঙ্কা করেছে তা নিয়ে যুগান্তরের পক্ষ থেকে অনুসন্ধান চালানো হয় দেশে একাধিক প্রবাসী পরিবারের ওপর। এতে দেখা গেছে, ইতালি-রোমের প্রবাসী ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বরের বাসিন্দা রিজভি রাজ্জাক রনি মোবাইলে যুগান্তরকে বলেন, বিগত ৮ বছরে প্রবাস জীবনে এমন খারাপ সময়ের মুখোমুখি হতে হয়নি। বিগত এক মাস স্ত্রীর কাছে এক টাকাও পাঠাতে পারেননি। ঢাকায় অবস্থান করা স্ত্রী নাজমুন নাহার ধার-দেনা করে চলছেন। গাজীপুর শ্রীপুরের বাসিন্দা সিঙ্গাপুরের প্রবাসী রানা মোবাইলে যুগান্তরকে বলেন, কাজ বন্ধ থাকায় আয় করতে এসে উল্টো ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। পরিবারের কোন টাকা দিতে পারছি না। কুয়েতে কর্মরত পুরান ঢাকার হাজারীবাগ গজমহলের বাসিন্দা আব্বাস উদ্দিন মোবাইলে যুগান্তরকে জানান, রোজা শুরু হলেও জিনিসপত্র কেনার জন্য বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারিনি। বেতন পরিশোধ করতে না পারায় নিজের ভাগিনাকে মাদ্রাসায় পাঠানো বন্ধ রেখেছেন। প্রবাসী পরিবারের আর্থিক সংকটের কথা তুলে ধরলেন বরিশালের হুমাইরা বেগম। তিনি জানান, তার স্বামী সৌদি আরবে থাকেন। দুই মাসের বেশি টাকা আসেনি, সামনে সংসার চালানো নিয়েই অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। চলতি মাসের বাড়িভাড়া পরিশোধ করতে পারেননি। তিনি বলেন, হাতে যা ছিল দুই-তিন মাস আগে পাঠানো টাকা, তা শেষের দিকে। আমি আর কয়েক দিন চলতে পারব। কবে তাদের লকডাউন ছাড়বে এটাও বলতে পারছেন না। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবে কাজ করেন সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সৌদি আরবে যে কড়াকড়ি চলছে তাতে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সবাই। এছাড়া মহামারীর প্রভাবে দেশটির তেলনির্ভর অর্থনীতিও মন্দার কবলে। এ অবস্থায় সৌদিতে বহু প্রতিষ্ঠানে বেতন কাটা হচ্ছে এবং শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হয়েছে বলে জানান সৌদি আরব প্রবাসী মো. জসিম উদ্দিন সরকার। তিনি বলেন, আমার কর্মরত কোম্পানিতে প্রচুরসংখ্যক শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছেন। এছাড়া বেতন কাটছাঁট করা হচ্ছে। খুলনায় এক পরিবারের স্বামী ও স্ত্রী ফেব্রুয়ারিতে দেশে এসেছেন। কবে আবার কাজে ফিরতে পারবেন সেটি নিয়েই তারা উদ্বিগ্ন। লন্ডন ফেরত প্রবাসী মুঞ্জুলিকা জামালী বলেন, উপার্জনকারী আমরা প্রত্যেকে এখন দেশে, একজন বিদেশে থাকলেও হয়তো সাপোর্ট পাওয়া যেত। সবমিলিয়ে করোনাভাইরাস মহামারী বিশ্বজুড়ে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি করেছে তার বহুমুখী প্রভাব দেখা দিয়েছে বাংলাদেশের বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী আয়েও। তা ওঠেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেমিটেন্স পাঠানোর সর্বশেষ হিসাবে। ব্যাংকের তথ্যমতে, গত মার্চ মাসে প্রবাসীরা ১২৮ কোটি ৬৮ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছে, যা চলতি অর্থবছরই শুধু নয়, বিগত ১৫ মাসের মধ্যেও সর্বনিম্ন।
মন্তব্য