নবীগঞ্জে চেয়ারম্যান মুকুল বরখাস্ত

নবীগঞ্জে গজনাইপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ইমদাদুর রহমান মুকুলের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। ৭ই জুলাই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ইফখার আহমদ চৌধুরী কর্তৃক স্বাক্ষরিতপত্রে তাকে বরখাস্ত করা হয়। এ ঘটনাকে মুকুল অধ্যায় ও রাজনৈতিক জীবনের পরিসমাপ্তি হিসেবে অভিহিত করেন বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। এছাড়াও উপজেলার অফিস পাড়ায় স্বস্তির খবর পাওয়া গেছে। মুকুল দাপটে অতিষ্ঠ প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা ঘটনাকে অহমিকার পতন হিসেবে অভিহিত করেন। বরখাস্তের খবর ছড়িয়ে পড়লে মঙ্গলবার রাতেই বিভিন্ন স্থানে মিষ্টি বিতরণ হয়। দৃশ্যমান দুর্নীতি ও বরখাস্তের ঘটনাকে রাজনীতির কলঙ্ক হিসেবে অভিহিত করেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। সার্বিক বিষয়ে নজরদারি করে হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ। দলীয় সিদ্ধান্তের পূর্বে মন্তব্যে অপারগতা প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগ নেতারা। অভিযোগ ও স্থানীয় সূত্রে প্রকাশ, প্রধানমন্ত্রীর সহায়তা তহবিল হিসেবে পরিচিত খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির (১০ টাকা কেজির) চাল নিয়ে অভিনব তেলেসমাতির ঘটনায় দৌড়ঝাঁপ করেও শেষরক্ষা হয়নি। এ ঘটনা ছাড়াও রাজনৈতিক সহকর্মী, সাধারণ জনগণ ও প্রশাসনের লোকজনকে তুচ্ছ জ্ঞানসহ ইমদাদুর রহমান মুকুলের বিরুদ্ধে সিরিজ দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। আপন সহোদরের শিক্ষক স্ত্রীকে মারধর, স্কুল, কলেজে ব্যক্তিগত সিন্ডিকেট, হাটবাজার ইজারা বাণিজ্য ছাড়াও পাহাড়ি অঞ্চলকে অপরাধের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করার বিস্তর অভিযোগ নিয়ে সরব উপজেলার জনপদ। চেয়াম্যানের দাপট ও দুর্নীতিতে অতিষ্ঠ গজনাইপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যরাও শেষ মুহূর্তে প্রতিবাদে সরব হন। সংরক্ষিত নারী সদস্যরা মুকুল আতঙ্কে তটস্থ ছিলেন। ঘটনা ধামাচাপার দিতে একাধিক গোপন বৈঠক থেকে প্রশাসনকে ম্যানেজ প্রক্রিয়ার গুজব ছড়ানো হয়। জল্পনা, কল্পনা আর নাটকীয়তা শেষে অহমিকার পতন ঘটে। বরখাস্ত হন চেয়ারম্যান মুকুল। আলোচিত ঘটনায় দুই দফা তদন্ত সম্পন্ন হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষকদের নিয়ে গঠিত কমিটি তালিকায় অনিয়মের সত্যতা নিশ্চিত করে। এছাড়াও হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসকের নির্দেশনায় গঠিত তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। গত বৃহস্পতিবার তদন্ত প্রতিবেদন জেলা প্রশাসকের কাছে প্রেরণ করা হয়। এ খবর নিশ্চিত করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিশ্বজিত কুমার পাল। জেলা প্রশাসক মো. কামরুল হাসান সোমবার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় প্রতিবেদন প্রেরণ করেন। এরই প্রেক্ষিতে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে মন্ত্রণালয়। ওদিকে, উপজেলা ও হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয় সূত্র জানায়, উপজেলার গজনাইপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ইমদাদুর রহমান মুকুলের বিরুদ্ধে ভুয়া তালিকায় গত চার বছর ধরে চাল আত্মসাতের অভিযোগ উঠে। চাল আত্মসাৎ ও প্রতারণার ঘটনা খতিয়ে দেখার জন্য উচ্চতর পর্যায়ের তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। এ ঘটনা ওই এলাকার খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ডিলার লিটন চন্দ্র দেবের ডিলারশিপ বাতিল করা হয়েছে। দৃশ্যমান তালিকায় দেখা গেছে, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ওই তালিকায় একাধিকবার একই ব্যক্তির নাম যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে ভুয়া নামের ছড়াছড়ি। শুধু তাই নয়, যে গ্রামে হিন্দু পরিবারই নেই, সেই গ্রামের তালিকায় রয়েছে অনেক হিন্দু উপকারভোগীর নাম। এমনকি সরকারি চাল হজম করতে তালিকায় মৃত ব্যক্তিসহ একই পরিবারের স্বামী, স্ত্রী ও সন্তানকে দেখানো হয়েছে ভিন্ন ধর্মের। এমনই অস্বাভাবিক ঘটনা নিয়ে হতবাক হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়। সমপ্রতি এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন জেলা প্রসাশক কামরুল হাসান। এরই প্রেক্ষিতে দ্রুত তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। আলোচিত ঘটনা নিয়ে রাতের আঁধারে একাধিক বৈঠকেও পরিষদ সদস্যদের ঐকমত্য হয়নি। স্থানীয় ইউপি সদস্যরা বলছেন, তারা চেয়ারম্যান ইমদাদুল রহমান মুকুলের নির্দেশে তালিকায় ৫০টি করে নাম দিয়েছেন। বাকি নামের বিষয়ে কোনো কিছুই তাদের জানা নেই। ইউনিয়নের ১১৮৫ জন সুবিধাভোগীর তালিকায় কয়েকশ’ ভুয়া নাম রয়েছে মর্মে অভিযোগ উঠে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিশ্বজিত কুমার পাল বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় প্রেরণ করা হয়। মন্ত্রণালয়ের আদেশ নিয়ে মন্তব্যের কিছু নেই। উল্লেখ্য, গজনাইপুর ইউনিয়নে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ১০ টাকা কেজি দরের চাল প্রাপ্তির উপকারভোগী রয়েছেন ১ হাজার ১৮৫ জন। ২০১৬ সালে ওই তালিকা তৈরি হয়। ২০২০ সালে তালিকায় সংশোধনীর নির্দেশনা দেয়া হলেও কর্ণপাত করেননি চেয়ারম্যান মুকুল। ওই ইউনিয়নের কয়েকজন ইউপি সদস্য বলেন, তারা ইউপি চেয়ারম্যান ইমদাদুর রহমান মুকুলের নির্দেশে তালিকায় ৫০টি করে নাম দিয়েছেন। বাকি নামের বিষয়ে কোনো কিছুই তাদের জানা নেই। চেয়ারম্যান ইমদাদুর রহমান মুকুল তালিকায় অনিয়মের বিষয়টি স্বীকারও করেন। জেলা প্রশাসকের নির্দেশনায় উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আজিজুর রহমান, মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাদেক হোসেন ও মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নুসরাত ফেরদৌসীকে নিয়ে তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি তদন্ত সম্পন্ন করে। কমিটির সদস্য নুসরাত ফেরদৌসী বলেন, যথাযথ ভাবে তদন্ত করেছি। প্রতিবেদন দিয়েছি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ নিয়ে কোনো প্রকার মন্তব্য প্রকাশের অবকাশ নেই। খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে অনিয়মের অভিযোগ ছাড়াও দুই মহিলার মাসিক ভিজিডির (প্রতিমাসে ৩০ কেজি) চাল আত্মসাতের লিখিত অভিযোগের তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন তিনি।