সিলেট নগরীর বন্দরবাজার ফাঁড়িতে ‘পুলিশি নির্যাতনে’ রায়হান আহমদের মৃত্যুর ঘটনায় ৮দিনেও কোনো আসামি গ্রেফতার না হওয়ায় ক্ষোভে ফুঁসছেন পরিবারের সদস্য এবং স্থানীয়রা। রোববার (১৮ অক্টোবর দুপুরে নগরীর আখালিয়া নেহারিপাড়াস্থ গুলতেরা মঞ্চিলে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বক্তব্য রাখেন রায়হানের মা সালমা বেগম। পরে ৬টি দাবি পেশসহ ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম ঘোষণা করেন স্থানীয় মুরুব্বি শওকত হোসেন। সিলেটভিউ’র পাঠকদের জন্য রায়হানের মায়ের পুরো বক্তব্যটি তুলে ধরা হলো- ‘‘পুত্র হত্যার বিচারপ্রার্থী এক অসহায় মায়ের আইবাদে সাড়া দিয়ে আজকের এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হওয়ায় আপনার সবার প্রতি জানাচ্ছি কৃতজ্ঞতা। আপনারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, আমার ছেলে রারহান আহমদ (৩৩) কে গত ১১ অক্টোবর রাতে বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে ডেকে নিয়ে বর্বর নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে। নারকীয় এই হত্যাকান্ডের ঘটনাটি আপনারা গণমাধ্যম কর্মীরাই সবার আগে জনসমক্ষে তুলে ধরেন। যা পুরাে সিলেটসহ সমগ্র বাংলাদেশ, এমনকি বর্হিবিশ্বেও বিবেকমান মানুষের অদয়ে নাড়া দিয়েছে। ফলে, দেশে বিদেশে সর্বস্তরের মানুষ রায়হান হত্যকারী খুনী পুলিশ সদস্যদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবীতে আন্দোলনে নেমে এসেছেন। আমাদের এলাকা বৃহত্তর আখালিয়াবাসী গত ১২ অক্টোবর থেকে লাগাতার আন্দোলন করে আসছেন। ইতােমধ্যে এলাকাবাসীর উদ্যোগে প্রতিবাদ সভা, বিক্ষোভ মিছিল, মানব বন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালিত হয়েছে। রায়হান হত্যকারী বন্দবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এস.আই আকবরসহ জড়িত সকল পুলিশ সদস্যের গ্রেফতারের দাবীতে ইতােমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও জেলা প্রশাসক মহােদয়ের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। সিলেটের সর্বস্তরের মানুষ আমাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু, দুঃখজনক হলেও সত্য রায়হান হত্যকান্ডে প্রধান অভিযুক্ত বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সাব ইন্সপেক্টর আকবর পুলিশী হেফাজত থেকে পালিয়ে যেতে ১ কম হয়েছে। সন্দেহভাজন হত্যাকারী আরাে ৮ পুলিশ সদস্য এখনাে পুলিশী হেফাজতে থাকলেও এখনাে তাদেরকে গ্রেফতার করা হচ্ছেনা। এ সব বিষয়ে কথা বলার জন্য আমি আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। জাতির বিবেক সাংবাদিক সমাজ, আপনারা জানেন, আমার ছেলে রায়হান আহমদ একজন ডাক্তারের চেম্বারের কর্মচারী হিসেবে কাজ করতাে। কে গত ১০ অক্টোবর দিবাগত রাতের কোন এক সময় তাকে আটক করে বন্দরবাজার ফাঁড়ির পুলিশ। পরে তাকে কটি সিএনজি অটোরিক্সাযােগে ফাঁড়িতে নিয়ে যায় পুলিশ সদস্যরা। ভাের সাড়ে ৪টার দিকে আমার নিজের মােবাইলে একটি কল আসে। কল রিসিভ করলে অপর প্রান্ত থেকে আমার ছেলে রায়হান আর্তনাদ করে বলে, 'আমাকে বাঁচাও। কিছু টাকা নিয়ে বন্দরবাজার পুলিশ ফাড়িতে আসাে। ফোন পেয়ে রায়হানের চাচা হাবিবুল্লাহ চৌধুরী ভাের সাড়ে ৫ টার দিকে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে পৌছান। ফাড়ির পুলিশের কাছে রায়হানের অবস্থান জানতে চান হাবিবুল্লাহ চৌধুরী। পুলিশ জানায়, রায়হান ঘুমিয়ে আছে এবং তাকে যারা ফাঁড়িতে নিয়ে এসেছে, তারাও চলে গেছে। কর্তব্যরত পুলিশ হাবিবুল্লাহ চৌধুরীকে সকাল সাড়ে ৯টার সময় ১০ হাজার টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে আসতে বলে। কথামতাে সকাল পৌনে ১০টার দিকে ১০ জার টাকা নিয়ে হাবিবুল্লাহ চৌধুরী বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে পৌছালে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা জানায়, রায়হান অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। রায়হানের চাচা হাবিবুল্লাহ চৌধুরী দ্রুত ওসমানী হাসপাতালের জরুরী বিভাগে উপস্থিত হয়ে জানতে পারেন, সকাল ৬টা ৪০ মিনিটের দিকে রায়হানকে ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে রায়হান মারা যান। খবর পেয়ে আমিসহ আমাদের আত্মীয় স্বজন ওসমানী হাসপাতালে উপস্থিত হয়ে আমার ছেলের রক্তাক্ত মৃতদেহ দেখতে পাই। এ ঘটনায় রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা পুলিশ সদস্যদের আসামী করে থানায় অভিযােগ দায়ের করেন, যা পরবর্তীতে মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয় কোতয়ালী জি. আর মামলা নং- ৪২৩/২০২০ ইং)। প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ, আপনারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, ঘটনার পর বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সাব ইন্সপেক্টর আকবরসহ হত্যকান্ডে জড়িত অন্যান্য পুলিশ সদস্যরা আমার ছেলেকে ছিনতাইকারী সাজিয়ে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের স্বজনরা ওসমানী হাসপাতালে থাকা আমায় ছেলের মৃতদেহে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন দেখে বিষয়টি গণমাধ্যমকে জানালে গণমাধ্যম কর্মীরা অনুসন্ধানে নামে। গণমাধ্যম কর্মদের অনুসন্ধানেই জানা যায়, ১১ অক্টোবর রাতে আমার ছেলে রায়হানকে আটক করে বন্দরবাজার পুলিশ ফাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। আমরা জানতে পারি, বন্দরবাজার হ ড়িতে তাকে আটকে রেখে রাতভর নির্মম নির্যাতন করা হয়। রাতেই বন্দর বাজার পুলিশ ফঁড়ির সাব ইন্সপেষ্টর তৌহিদ এলাহীর মােবাইল ফোন থেকে আমাকে কল করে ১০ হাজার টাকা চাওয়া হয়। বন্দরবাজার ফঁড়ির ইনচার্জ সাব ইন্সপেষ্টর আকবার হােসেন ভূইয়ার নেতৃত্বে আমার ছেলেকে অকথ্য নির্যাতন করা হয়। রায়হানের দুই হাতের কজি ও পায়ের হাড় আঘাতের পর আঘাতে ভেঙ্গে দেয়া হয়। তার হাতের আঙ্গুলের নখ প্লায়ার্স দিয়ে টেনে তুলে ফেলা হয়। প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ, আপনাদের মাধ্যমে এসব তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ার পর পুরাে সিলেটবাসী তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েন। নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে রায়হানকে হত্যকারী পুলিশ সদস্যদের গ্রেফতার ও শান্তির দাবীতে বৃতহত্তর আখালিয়াসহ পুরাে সিলেটের মানুষ রাজপথে নেমে আসেন। ফলে, বাধ্য হয়ে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কর্তৃপক্ষ বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ সাব ইন্সপেক্টর আকবরসহ ও পুলিশ সদস্যকে বরখাস্ত করেন এবং আরাে ৩ জনকে প্রত্যাহার করেন। নির্মম এই হত্যকান্ডের ঘটনায় রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি থানায় মামলা দায়ের করতে গেলে থানা কর্তৃপক্ষ মামলা নিতে গড়িমশি করেন। পরে, সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর)-এর লিখিত নির্দেশের পর থানা কর্তৃপক্ষ অজ্ঞাতনামা আসামীদের বিরুদ্ধে মামলা নিতে বাধ্য হন। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত: পুলিশের এই চিঠি চালাচালির পর্যায়েই মূল আসামী, বন্দরবাজার পুলিশ ফাড়ির ইনচার্জ আকবর হােসেন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। পুলিশ এখনাে তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি। মামলার তদন্তভার ইতােমধ্যে পুলিশ ইনভেস্টিগেশন ব্যুরাে (পিবিআই)-এর নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে। ইতােমধ্যে রায়হানের লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে দ্বিতীয় দফা ময়না তদন্ত সম্পন্ন করা হয়েছে। আমরা যতদূর জানতে পেরেছি, ওসমানী হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, গুরুতর আঘাতের কারণেই রায়হানের মৃত্যু হয়েছে। কিন্ত, রায়হান হত্যকারী পুলিশ সদস্যদের কাউকে এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়নি। ফলে, রায়হান হত্যা মামলার ভবিষ্যত নিয়ে আমাদের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় আমরা নিহত রায়হানের পরিবার ও বৃহত্তর আখালিয়া এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে নিম্নলিখিত দাবীসমূহ উপস্থাপন করছি- ১. রায়হান হত্যকান্ডের বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবী করছি। এ বিষয়ে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের দাবীতে আমরা ইতােমধ্যে সিলেটের মাননীয় জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে মাননীর প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান করেছি। ২, রায়হান হত্যায় জড়িত বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আকবার হােসেন ভূঁইয়া সহ দোষী সকল পুলিশ সদস্যকে অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবী জানাচ্ছি। ৩. পলাতক সাব ইন্সপেষ্টর আকবর হােসেনকে গ্রেফতারে মাননীয় আইজিপির নির্দেশ কামনা করছি। ৪. পুরাে ঘটনার ব্যাপারে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার কর্তৃক একটি পূর্ণাঙ্গ বক্তব্য প্রদানের দাবী জানাচ্ছি। ৫, রায়হান হত্যার ঘটনায় নিহতের পরিবারকে উপবুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিনীত আবেদন জানাচ্ছি। ৬. আগামী ৭২ ঘন্টার মধ্যে খুনী পুলিশ ইন্সপেক্টর আকবরসহ হত্যায় জড়িত সকল পুলিশ সদস্যকে গ্রেফতার করা না হলে বৃহত্তর আখালিয়াবাসীর উদ্যোগে হরতাল, সড়ক অবরােধসহ কঠোর কর্মসূচি ঘােষণা করা হবে এবং উদ্ভুত যে কোন পরিস্থিতির দায়ভার সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কর্তৃপক্ষকে বহন করতে হবে। পরিশেষে এতক্ষণ ধৈর্য্য ধরে আমার বক্তব্য শােনায় আপনাদেরকে জানাচ্ছ অশেষ কৃতজ্ঞতা।’’
মন্তব্য