সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি

বাঁশির সুরে কে না থমকে দাঁড়ায়? সুরের যাদু দিয়ে বংশি বাদক শ্রোতাকে টেনে নেন নিজের কাছে। রাজা বাদশাহ্দের আমলে রাজ-দরবারে নিয়োগ দেয়া হতো বংশি বাদক। যখনই রাজার মনে সুর চাইতো হুকুম দিলেই সুর বেজে উঠতো বংশি বাদকের। রাজা সুরের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দিতেন। এখন রাজা বাদশাহও নেই। বংশি বাদকও কমে গেছে। রাস্তাঘাটে মাঝে-মধ্যে বাঁশির সুর বেজে উঠে। বাঁশির এ সুর গিয়ে বিঁধে মানুষের বুকে। এই বাঁশি কত প্রেমিক জুটিকে জোড়া লাগিয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। কত প্রমিকা যে বাঁশির সুরের মূর্ছনায় সংজ্ঞা হারিয়েছেন। এই বাঁশির সুরেই অতীতে ফিরে যান অনেকে। এই বাঁশিই এক সময় হয়ে উঠে বিরহের মালা। তখনও দরাজ কণ্ঠে ভেসে আসে - বাঁশি শুনে আর কাজ নেই/ সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি। সত্যিই বাঁশি এখন হয়ে উঠেছে ডাকাতিয়া বাঁশি। বর্তমান প্রজন্ম বাঁশি নিয়ে আর খেলা করে না। চরম আধুনিকতায় তারা নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে। এভাবেই সামাজিক অবক্ষয় জেঁকে বসে সমাজে। মুনি ঋষিরা বলে গেছেন- আত্মনং বিদ্ধি। ‘নিজেকে জানো’। রবীন্দ্রনাথ তো আরও একটু এগিয়ে বলেছেন- ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশ পাথর। অর্থাৎ মানুষ নিজের আত্মাকে খুঁজে বেড়ায় নিজেকে চেনার জন্য। সত্যিই সবার আগে দরকার নিজেকে চেনার, নিজেকে জানার। আর নিজেকে চেনা ও জানার মাধ্যমেই ভুল-ক্রটি শুধরে নেয়া সম্ভব। কে আমি। কোথা থেকে এলাম, কোথায় যাচ্ছি? এ জটিল বিশ্বে আমার কি ভূমিকা? মানুষের ভালো করার জন্য আমি কি করতে পারি? এসব নিয়ে মনীষীরা মানুষকে ভাবতে বলেছেন, চিন্তা করতে বলেছেন, মাথার ব্যায়াম করতে বলেছেন, এভাবেই নিজেকে জানতে বলেছেন। তবে মুশকিল হচ্ছে, এসব খুবই জটিল চিন্তা-ভাবনা। এর কোনো সোজা উত্তর নেই। ভাবনার কোনো শেষ নেই। ইচ্ছা করলে যে কেউ ভাবতে ভাবতে পাগল হয়ে যেতে পারেন। তবে পাগল হতে কার ভালো লাগে? পাগলের প্রসঙ্গ যখন এলো তখন ছোট একটা ঘটনা বলে ফেলি। এক বাড়িতে একটা পাগল ছিল। মৌসুমি পাগল। সারা বছরই ভালো থাকতো, বছরের একটা সময় পাগল হয়ে যেত। তবে তেমন ক্ষতিকারক পাগল নয়। পাগল হলে সে তাদের বাড়ি কাউকে ঢুকতে দিতো না। প্রতিশোধ নিতে পাড়ার ‘শেক্সপিয়ররা’ সেই পাগল বাড়ির দেয়ালে দুই লাইন ছড়া লিখে দিয়েছিল- কর্তা পাগল-গিন্নি পাগল/ পাগল দুই চেলা/সেথা সাত পাগলের মেলা। খেয়াল করলে দেখা যায়, মুনি ঋষি থেকে শুরু করে শেক্সপিয়র, রবীন্দ্রনাথ, গ্রিক দার্শনিক সবাই লম্বা ‘সফেদ’ দাড়ির অধিকারী ছিলেন। তারা নিজেকে চেনার জন্য জানার জন্য এতই ব্যস্ত ছিলেন যে, সেভ করারও সুযোগ পাননি জীবনে। ঋষিরা সেজন্যই বুঝি পরামর্শ দিয়েছেন আগে নিজেকে জানো। আর নিজেকে জানলে, অন্যকে জানারও সুযোগ হবে। আর তখন বংশি বাদক তার বাঁশিতে সুর টান দেবে। বাঁশি শুনে আর কাজ নেই/ সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি/ সে যে দিন-দুপুরে চুরি করে রাত্রিরেতে কথা নাই/ ডাকাতিয়া বাঁশি/ বাঁশেতে ঘুণ ধরে যদি/ কেন বাঁশিতে ঘুণ ধরে না/ কতজনায় মরে শুধু পোড়া বাঁশি কেন মরে না/ বাঁশি শুনে আর কাজ নাই সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি।