৫ মাসে বেড়েছে লিটারে ২২ টাকা ভোজ্য তেলের দামে রেকর্ড

দেশে ভোজ্য তেলের দাম বেড়েই চলেছে। দাম বৃদ্ধিতে রেকর্ডও গড়েছে। চলতি সপ্তাহে খুচরা বাজারে লিটারে ৪ টাকা বেড়েছে। গত পাঁচ মাসে বোতলজাত সয়াবিনের দাম বেড়েছে লিটারে ২২ টাকা। আর পাইকারিতে মণপ্রতি বেড়েছে ২০০ টাকা। খোলা পাম তেলের দামও বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা জানান, পাইকারি ও খুচরা বাজারে ভোজ্য তেলের দাম যেভাবে বেড়েছে তা ২৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। তাদের মতে, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় হওয়ায় দেশের বাজারেও ভোজ্য তেলের দাম বাড়ছে। আন্তর্জাতিক বাজারেই ভোজ্য তেলের সরবরাহ কম। শুল্ক কমিয়ে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যেতে পারে বলে মনে করেন তারা। কাওরান বাজারসহ বেশ কয়েকটি বাজারে দেখা গেছে, রূপচাঁদা ব্র্যান্ডের ৫ লিটারের এক বোতল সয়াবিন তেল ৫৭৫-৫৯০, বসুন্ধরা ব্র্যান্ডের তেল ৫৭০-৫৮০ টাকা এবং পুষ্টি ও তীর ব্র্যান্ডের তেল ৫৫০-৫৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বিক্রেতারা জানিয়েছেন, এক সপ্তাহ আগের তুলনায় দাম ৫ লিটারে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়েছে। ব্র্যান্ড ভেদে বোতলজাত সয়াবিন তেলের ১ লিটারের বোতলের দাম ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা। এক সপ্তাহ আগে তা ১২০ থেকে ১২৫ টাকা ছিল বলে দাবি বিক্রেতাদের। এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে ১২০-১২৫ টাকা কেজি, যা সপ্তাহখানেক আগে ১১৮-১২০ টাকা ছিল। মৌলভীবাজারে পাইকারিতে সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে ৪ হাজার ৪০০ টাকা মণ (৩৭.৩২ কেজি) বা ১১৮ টাকা কেজি। গত সপ্তাহে পাইকারিতে ছিল ৪ হাজার ২০০ টাকা মণ বা ১১২ টাকা কেজি। দেশে গত আগস্ট মাসে ৫ লিটারের এক বোতল সয়াবিন তেলের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) ছিল ৫০৫ থেকে ৫১৫ টাকা। বর্তমানে তা ৬১৫ থেকে ৬২৫ টাকা। অর্থাৎ গত ৫ মাসে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ২২ টাকা বাড়িয়েছে কোম্পানিগুলো। সয়াবিনের মতো পাম তেলের দামও বেড়েছে। পাইকারিতে পাম সুপার বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৯০০ টাকা মণ, যা গত সপ্তাহে ১০০ টাকা কম ছিল। খুচরায় পাম সুপার বিক্রি হচ্ছে ১১০-১১৫ টাকা লিটার। সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, ১ লিটার খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে ১০৮ থেকে ১১০ টাকায়, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ১০৭ থেকে ১০৯ টাকা। গত বছর এ সময় খোলা সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৯১-৯৩ টাকা লিটার। টিসিবি তথ্য অনুযায়ী, পাম সুপার তেল ২ থেকে ৩ টাকা বেড়ে প্রতি লিটার ১০০-১০২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মালিবাগ বাজারের মুদি দোকানি আতিক বলেন, বাজারে চাহিদামতো সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে দাম বাড়তি। আমার আগের তেলই রয়েছে, তাই ১২২ টাকায় বিক্রি করতে পারছি। কাওরান বাজারের সোনালী ট্রেডার্সের মালিক আবুল কাশেম বলেন, কোম্পানিগুলো যে দাম নির্ধারণ করেছে, ক্রেতারা সেই দামেও তেল কিনতে চান না। পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মওলা বলেন, তেলের বাজার ভয়াবহ খারাপ। দাম বাড়ছেই। গত ২৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তেলের দাম উঠেছে। তিনি বলেন, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও যুক্তরাষ্ট্র আমাদের আমদানির বড় বাজার। এসব দেশে করোনার কারণে উৎপাদন কম। এ ছাড়া চীন এবার ব্যাপকহারে তেল কিনেছে। ফলে সংকটের মধ্যে আরো সংকট তৈরি হয়েছে। মিলমালিক ও সরকার পদক্ষেপ নিলে দামের রাস টানা যেতে পারে বলে তিনি মনে করেন। তবে দাম বাড়লেও বাজারে তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে এবং কোনো সংকট নেই। এদিকে গত অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনে ভোজ্যতেলের ওপর শুধু আমদানি পর্যায়েই ভ্যাট নেয়ার জন্য আবেদন করেছিল ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিট্যাবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশন। আবেদনে সংগঠনটি জানায়, বর্তমানে ভোজ্যতেলের মধ্যে সয়াবিন, পাম ও পাম অলিন তেলের ওপর আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ৫ শতাংশ আগাম কর (এটি), উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট এবং বিক্রয় ও সরবরাহ পর্যায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের ওপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট রয়েছে। গত ডিসেম্বর মাস থেকে বিশ্ববাজারে বেড়েছে খাদ্যপণ্যের দাম। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) জানায়, গত দুই মাসে ব্যাপকভাবে বেড়েছে ভোজ্যতেলের দাম, ফলে সার্বিকভাবে খাদ্যপণ্যের এই বাজার ঊর্ধ্বমুখী। ডিসেম্বরে ভোজ্যতেলের দাম আগের মাসের চেয়ে বেড়েছে ৪.৭ শতাংশ, যা ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরের চেয়ে সর্বোচ্চ। এর আগের মাস নভেম্বরে বেড়েছে ১৪.০ শতাংশ। পুরো ২০২০ সালে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে ১৯.১ শতাংশ। এদিকে চালের আমদানি শুল্ক কমানোর খবরে চালের বাজারে কিছুটা প্রভাব পড়েছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকা চালের দাম শুক্রবার আর বাড়েনি। বরং সামান্য হলেও কমেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুক্রবার খুচরা ও পাইকারি দুই বাজারেই চিকন ও মাঝারি চালের কেজিতে কমেছে ২ টাকা করে। চাল ব্যবসায়ীরা বলেন, আমদানিকৃত চাল চলে আসবে এমন খবরে প্রভাব পড়েছে বাজারে। গত সপ্তাহের চেয়ে ও মাঝারি চালের কেজিতে ২ টাকা করে কমেছে। প্রতিকেজি সরু চাল ৫৮-৬৪ টাকা দরে বিক্রি করছেন। মাঝারি মানের চাল ৫০-৫৮ টাকা কেজি এবং মোটা চাল বিক্রি করছেন ৪৬-৫০ টাকা কেজি। অর্থাৎ চিকন ও মাঝারি চালের দাম কমলেও মোটা চালের দাম এখনো নাগালের বাইরে রয়েছে। এদিকে বাজারে শীতের সবজির দামও কমেছে। বেশিরভাগ শীতকালীন সবজি ২০-৩০ টাকা কেজিতে পাওয়া যাচ্ছে। ফুলকপি, বাঁধাকপি, শিম, মুলা, শালগমের সরবরাহ বেড়েছে। ফুলকপি ও বাঁধাকপি প্রতি পিস বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকায়। ২০ টাকা কেজি শালগম। মুলা ১০-১৫ টাকা কেজিতে পাওয়া যাচ্ছে। ৩০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে বড় লাউ। গাজর বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা কেজি। বেগুনের কেজি ৩০ টাকা, করলার কেজি ৩০ টাকা। সব ধরনের শাক বিক্রি হচ্ছে ৫-১০ টাকা আঁটি। তবে শিমের কেজি বিক্রি হচ্ছে এখনো ৩০-৫০ টাকা। বাজার কেনাকাটা করতে আসা কুলসুম বেগম বলেন, বাজারে সবজির দাম কমেছে। তবে চাল ও তেলের দাম অনেক বেশি। চাল-তেল কিনতেই অনেক টাকা বাড়তি চলে যাচ্ছে।