অনেক চেষ্টায়ও বিরোধ মেটেনি ড. কামাল হোসেনের গণফোরামে। বরং সম্প্রতি দলটির সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে ড. রেজা কিবরিয়া পদত্যাগ করেছেন। অন্যদিকে জ্যেষ্ঠতা নিয়েও দলটির নেতাদের মধ্যে নতুন করে বিরোধ তৈরির খবর পাওয়া গেছে। নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রের দাবি, ড. কামালসহ বিবদমান দুই অংশের পাঁচজন করে মোট ১১ জন নেতার সমন্বয়ে দলের একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হলেও সংসদ সদস্য মোকাব্বির খানের নাম তালিকায় এক নম্বরে দেওয়ায় ওই বিরোধের সূত্রপাত হয়েছে। দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু, অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, অধ্যাপক আবু সাইয়িদসহ সিনিয়র অনেক নেতা এই ক্রমবিন্যাস মেনে নিতে পারেননি। তাঁরা মনে করছেন, সংসদ সদস্য হওয়ায় মোকাব্বির খান নিজেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন এবং আগামী কাউন্সিলে তিনি দলের সভাপতি হতে চাইছেন। এমনকি তাঁর সমর্থক বলে পরিচিত আ ও ম শফিকউল্লাহর নামও তাঁদের আগে দেওয়া হয়েছে বলে ওই অংশ জানতে পেরেছে। সূত্র মতে, এ কারণেই দুই অংশের বিরোধ মীমাংসার ঘোষণা আটকে আছে। সর্বশেষ গত ১৬ জানুয়ারি ড. কামাল হোসেন সংবাদ সম্মেলনের ঘোষণা দিয়েও পরে তা বাতিল করেন। তবে জানতে চাইলে মোকাব্বির খান এই ঘটনাকে ‘বাজে কথা’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ‘নামের তালিকা চূড়ান্ত হয়নি। যাঁরা দলের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করতে চান তাঁরাই এগুলো ছড়াচ্ছেন।’ মোস্তফা মহসিন মন্টু বলেন, ‘দলীয় কর্মসূচি নিয়ে আমরা সারা দেশে মাঠে আছি। তবে কিছু সমস্যার কারণে সংবাদ সম্মেলন আটকে আছে।’ সাবেক নির্বাহী সভাপতি অ্যাডেভোকেট সুব্রতর মতে, ‘দলকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে দলের কেউ কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে বিঘ্ন সৃষ্টি করছেন। এঁরা দলের ভালো চান না।’ ২০১৯ সালের ঘোষিত কমিটিতে ড. আবু সাইয়িদ ও সুব্রত চৌধুরী গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি ছিলেন। আর ১৯৯৩ সালে গঠিত প্রথম কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক থাকলেও ২০১২ সালে মন্টু দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। মোকাব্বির খান ওই কমিটির সভাপতি পরিষদের তালিকায় ৬ নম্বর এবং অ্যাডভোকেট শফিকউল্লাহ ১১ নম্বর সদস্য ছিলেন। গত বছরের মার্চে ওই কমিটি ভেঙে দিয়ে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হলে দলে বিরোধ তৈরি হয়। তখন ওই তিন নেতাসহ সিনিয়র আরো অনেককে বাদ দেওয়া হলে গণফোরামে বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। এরপর কিবরিয়া ও মন্টু সমর্থকদের মধ্যে বহিষ্কার-পাল্টাবহিষ্কারের ঘটনা ঘটে। এমন পরিস্থিতিতে বিরোধ মীমাংসায় গত ডিসেম্বরে ড. কামাল হোসেনের সভাপতিত্বে দুই অংশের বৈঠকে ১১ সদস্যের স্টিয়ারিং কমিটির মাধ্যমে দল পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়। সূত্র জানায়, সিদ্ধান্ত অনুয়ায়ী মন্টু সমর্থকদের মধ্য থেকে তিনি ছাড়াও আবু সাইয়িদ, সুব্রত চৌধুরী, জগলুল হায়দার আফ্রিক ও মহিউদ্দিন আবদুল কাদেরের নাম ড. কামাল হোসেনের কাছে যায়। অন্য অংশের মধ্যে মোকাব্বির খান, মোহাম্মদ জানে আলম, শফিকউল্লাহ, সেলিম আকবর ও সুরাইয়া বেগমের নাম দেওয়া হয়। তবে নামের ওই দুই তালিকা একত্র করে স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করতে গেলে কার নাম আগে-পরে যাবে তা নিয়ে বিরোধ তৈরি হয় বলে জানা যায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণফোরামের অন্তত দুজন নেতা জানান, ‘সিনিয়রিটি-জুনিয়রিটি দেখে নামের ক্রম ঠিক করার মতো অবস্থা ড. কামালের নেই।’ মোকাব্বির খানের প্রতি ইঙ্গিত করে তাঁরা বলেন, এসব তিনি বা তাঁর সমর্থকরাই করাচ্ছেন। সম্ভবত আগামী কাউন্সিলে তিনি দলের সভাপতি হতে চান।’ এদিকে, গণফোরামের পাশাপাশি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কর্মসূচি মনঃপূত না হওয়ায় ড. রেজা কিবরিয়া কয়েক মাস আগে থেকেই দলীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো থেকে জানা যায়, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার পাশাপাশি সারা দেশের রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি ও সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন রেজা কিবরিয়া। এ ছাড়া সীমান্ত হত্যা বন্ধে ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কঠোর বিবৃতি দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর এসব প্রস্তাবের কোনোটিই দল বা জোট গ্রহণ না করায় তিনি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই গণফোরামের দুই অংশের বিরোধ মেটানোর উদ্যোগে তিনি জড়িত হননি। তা ছাড়া ১১ সদস্যের স্টিয়ারিং কমিটি দল পরিচালনা করলে সাধারণ সম্পাদকের ভূমিকাও অগুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। তাই সব দিক বিবেচনা করে সম্প্রতি ড. কামাল হোসেনের কাছে চিঠি দিয়ে তিনি পদত্যাগ করেন বলে জানা গেছে। সূত্র মতে, চিঠিতে তিনি পদত্যাগের কারণ ‘ব্যক্তিগত’ বলে উল্লেখ করলেও ড. কামাল হোসেনকে অসম্মান করে কিছু বলেননি। আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে ড. রেজা কিবরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের সুসম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করা হয়। অনেকের মতে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বাইরে বিকল্প কোনো শক্তির মেরুকরণ হলে রেজা সেখানে গুরুত্ব পাবেন। ‘তৃতীয় শক্তি’র চোখ তাঁর দিকে—এমন গুঞ্জন রয়েছে তাঁকে কেন্দ্র করে।
মন্তব্য