বানিয়াচং প্রতিনধি:বানিয়াচংয়ে মা-মেয়ে হত্যা মামলার প্রধান আসামী ঘাতক শেলু মিয়া (৩০) কে গ্রেফতার করেছে জেলা পুলিশের বিশেষ একটি দল। আর তাকে গ্রেফতারের মাধ্যমে ডাবল মার্ডারের রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ। মূল ঘাতক জামাতা শেলু মিয়ার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান। এতে করে বেড়িয়ে এসেছে হত্যাকান্ডের চাঞ্চল্য কর তথ্য। এক সাথে বৃদ্ধ মা ও তার বিবাহিতা মেয়েকে কুপিয়ে হত্যার ১৫ দিনের মধ্যে মূল রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে হবিগঞ্জ জেলা পুলিশ।
হবিগঞ্জ জেলা পুলিশের অভিযানের ফলে চাঞ্চল্যকর ডাবল মার্ডারে মূল রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হয়েছে। বুধবার (২ অক্টোবর) বিকেলে হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলামের আদালতে স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দীতে হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা দেয় ঘাতক জামাতা শেলু মিয়া। এ ঘটনায় হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা বুধবার রাত ১১টায় পুলিশ সুপার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। এর আগে গত মঙ্গলবার দুপুরে তার তত্ত্বাবধানে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এসএম রাজু আহমেদ, শৈলেন চাকমা, ডিবি’র ওসি মানিকুল ইসলাম, এসআই ধ্রুবেশ চক্রবর্তী, এসআই আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে একদল পুলিশ নবীগঞ্জ এলাকায় অভিযান চালিয়ে ঘাতককে গ্রেফতার করেন। সে হবিগঞ্জ শহরের উমেদনগর এলাকার নুর মিয়ার পুত্র।
জানা যায়, গত সেপ্টেম্বর বানিয়াচং উপজেলার ১২নং সুজাতপুর ইউনিয়নের শতমুখা গ্রামের অংশে হবিগঞ্জ শহর থেকে খোয়াই নদীর ভাটির দিকে অনুমান ৩৫ কি.মি. দূরে নদীতে ভাসমান অবস্থায় অর্ধগলিত অজ্ঞাতনামা নারীর লাশ (৩৫) উদ্ধার করে সুজাতপুর তদন্ত কেন্দ্র। তাৎক্ষণিক ভাবে মৃতদেহের পরিচয় সনাক্ত করতে না পেরে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের মাধ্যমে দাপন করা হয়। মৃতের সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত কালে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে একাধিক আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। পরে সুজাতপুর তদন্ত কেন্দ্রর ইনচার্জ এসআই ধ্রুবেশ চক্রবর্তী বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামীর বিরুদ্ধে বানিয়াচং থানায় একটি মামলা নং-১৬ দায়ের করেন। এর কিছু দিন পর গত ১৯ সেপ্টেম্বর বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে জেলার বানিয়াচং থানার ১২নং সুজাতপুর ইউনিয়নের পূর্ব বাজুকা গ্রামের অংশে খোয়াই নদীর ভাটির দিকে নদীতে ভাসমান অবস্থায় পঁচাগলা অজ্ঞাতনামা মহিলা (৫০) এর লাশ উদ্ধার করে সুজাতপুর তদন্ত কেন্দ্রের পুলিশ। প্রাথমিকভাবে মৃতের ছেলে মো. ফুল মিয়া সনাক্ত করেন ওই বৃদ্ধ মহিলা তাঁর মা বলে পরিচয় নিশ্চিত করেন। একই সাথে সে জানায় গত সেপ্টেম্বর থেকে তার মা ও বোন নিখোঁজ রয়েছে। আর এতে করেই নড়েচড়ে বসে বানিয়াচং থানা পুলিশসহ জেলা পুলিশ। বৃদ্ধা মহিলা হত্যার রহস্য উদঘাটনে মাঠে নামে জেলা পুলিশের কয়েকটি টিম।
এরই মধ্যে শহরের এক ভিক্ষুকের কাছ থেকে নিহত ফুলবরণ নেছার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি উদ্ধার করে। এ মোবাইল ফোন উদ্ধারের মাধ্যমে পুলিশ নিশ্চিত হয় খোয়াই নদী থেকে উদ্ধার হওয়া লাশ দুটি মা-মেয়ের। পরে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যার নির্দেশে একের পর এক অভিযান চালায় বানিয়াচং থানা পুলিশ ও জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। অভিযান চালিয়ে হবিগঞ্জ শহরের উমেদনগর থেকে গ্রেফতার করা হয় ফুলবরণ নেছার স্বামী মো. শেলু মিয়াকে। গ্রেফতারকৃত সেলু মিয়াকে ডিবি কার্যালয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের পর বেড়িয়ে আসে লোমহর্ষক এ হত্যাকান্ডের রহস্য।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই এম এ ফারুক আহমেদ। গত রাত ১১টায় পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা (বিপিএম-পিপিএম) এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, প্রায় ২ বছর পূর্বে হবিগঞ্জ সদর থানাধীন উমেদনগরস্থ নুর মিয়ার পুত্র সেলু মিয়া (৩০) এর সাথে মো. ফুল মিয়ার নিখোঁজ বোন ফুলবরণ নেছা’র বিয়ে হয়। বিয়ের কিছু দিন পর থেকে পারিবারিক বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে কলহ সৃষ্টি হয় এবং এক পর্যায়ে সেই কলহ চরম আকার ধারণ করে। এ নিয়ে ২য় স্ত্রী ফুলবরণ নেছা’র সাথে বিজ্ঞ আদালতে মামলা মোকদ্দমাও চলতে থাকে। গত ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ মা ও বোন হবিগঞ্জ সদর কোর্টে আসার জন্য পূর্বের দিন বিকালে বানিয়াচং নিজ বাড়ী থেকে বের হয়ে হবিগঞ্জ শহরস্থ উমেদনগরে তার চাচাতো ভাই এনামুল এর ভাড়া বাসায় রাত্রিযাপন করেন। পরদিন অর্থাৎ ৫ তারিখ সকাল বেলা সেলু মিয়া ফোন পেয়ে এনামুল এর বাসায় চলে আসে। বাসায় তার সাথে তার স্ত্রী, শ্বাশুড়ী, এনামুলসহ মামলা মোকদ্দমা নিষ্পত্তির বিষয়ে কথাবার্তা বলে। এক পর্যায়ে সেলু চৌধুরী বাজারস্থ তাঁর পিতার দোকানে চলে যায়।
ওই দিন বিকালে সেলু মিয়া তার স্ত্রী ও শ্বাশুড়ীকে ফোন দিয়ে চৌধুরী বাজারস্থ মায়া হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্টে এনে কথাবার্তা বলে। তারপর সে আসর এর নামাজের পর তাদেরকে নিয়ে শহরের উমেদনগরস্থ তাঁর নিজ বাড়ীতে নিয়ে যায়। সেখানে তার বাবার সাথে শ্বাশুরির মামলা নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে তার বাবা সেলুকে বলে “তুই আমার মুখে চুনকালি দিছস্। হয় তুই বিষ খাইয়া মর-না হয় আমাকে বিষ দে খাইয়ালামু।” তখন সে মনের দুঃখে বাড়ী থেকে বের হয়ে তার শ্যালক ও শ্বশুড় লিল মিয়াকে ফোন করে তার স্ত্রী’র বিষয়ে নালিশ করে। কিন্তু সে তাদের কাছ থেকে কোন শান্তনামূলক জবাব পায়নি। তারপর স্ত্রী ও শ্বাশুড়ীকে নিয়ে পায়ে হেঁটে কিবরিয়া ব্রীজের চায়ের দোকানে তাদের রেখে সে বের হয়ে এবং ১ম স্ত্রীর পিতা তাজুল মিয়াকে ফোনে তার শ্যালক আনোয়ার (২০) সহ তার সবজি দোকানের লাউ কাটার দা’টি সাথে নিয়ে আসতে বলে। সে তখন একটি সিএনজি খোঁজলে তার পরিচিত চালককে পেয়ে ১২০/- টাকা ভাড়ায় হত্যাকান্ডেরস্থল গোবিন্দপুর যাওয়ার জন্য ঠিক করে এসে তার ২য় স্ত্রী ও শ্বাশুড়ীকে বলে তোমাদের জন্য নতুন একটি বাসা ভাড়া ঠিক করেছি সেটা দেখতে যাব। এই বলে তাদেরকে সিএনজিতে নিয়ে আসে। ইতিমধ্যে তাঁর ১ম স্ত্রীর পিতা ও ভাই সিএনজি’র কাছে চলে আসলে সেলু তার স্ত্রী ও শ্বাশুড়ীকে নিয়ে পিছনে বসে, শ্বশুড় ও শ্যালক সামনে ড্রাইভারের পাশে বসে গোবিন্দপুরের উদ্দ্যেশে রওনা হয়। পৌছার ৫০ গজ আগে সিএনজি থামিয়ে তারা সবাই নেমে ড্রাইভারকে গাড়ী ঘুরিয়ে তাকে সিএনজিতে থাকতে বলে।
এর পর তারা বেড়ি বাঁধ ধরে কিছু দূর সামনে নির্জন অন্ধকারে গিয়ে খোয়াই নদীর চরে পৌঁছামাত্র তারা সবাই মিলে তার স্ত্রী ও শাশুড়িকে এলোপাথাড়ি গাছের ঢাল দিয়ে বেধড়ক মারতে থাকে। এক পর্যায়ে প্রথমে শাশুড়ি ও পরে স্ত্রী অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। তখন তার শ্বশুর দা দিয়ে শাশুড়িকে কুপিয়ে আঘাত করে। সেলু তার শ্বশুরের কাছ থেকে দা নিয়ে তার শ্যালক মিলে স্ত্রীকে কুপিয়ে আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। তাদের সিএনজিতে ফিরতে দেরি হওয়ার ফলে ড্রাইভার সামনে এগিয়ে আসলে তাদের সামনে দুই জনের মৃতদেহ দেখে সে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা কালে সেলু তাকে দেখে ফেলে এবং হত্যাকান্ডে ফাঁসানোর হুমকি দেয়। সেই সাথে তাকে মৃতদেহ নদীতে ফেলতে সহায়তা করতে বাধ্য করে সেলু। মৃতদেহ দু’টি তার শ্বশুড়, শ্যালক, সিএনজি ড্রাইভার ও সেলু মিলে খোয়াই নদীতে ফেলে দিয়ে ওই সিএনজি দিয়ে ফিরে কিবরিয়া ব্রিজে নেমে যে যার মত করে বাসায় চলে যায়। নিহত ফুলবরণ নেছা বানিয়াচং থানার তারাসই গ্রামের লিল মিয়ার মেয়ে এবং অপর নিহত জমিলা খাতুন লিল মিয়ার স্ত্রী।
উল্লেখ্য, ঘটনার এক মাস পূর্বে সেলু ও তার শ্বশুর তাজুল মিয়া মিলে মামলা সংক্রান্ত বিষয়ের জের ধরে তাঁর ২য় স্ত্রীকে মারার পরিকল্পনা করে। প্রেস ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বানিয়াচং সার্কেল শৈলেন চাকমা, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হেড কোয়াটার এস এম রাজু আহমেদ, জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ইনচার্জ মো. মানিকুল ইসলাম, মোহাম্মদ এমরান হোসেন, লাখাই থার ওসি মো. সাইদুল ইসলাম, সুজাতপুর তদন্ত কেন্দ্রর ইনচার্জ এসআই ধ্রুবেশ চক্রবর্তী, ডিবির এসআই আবুল কালাম আজাদসহ জেলা পুলিশের কর্মকর্তাগণ।
মন্তব্য