আশাবাদী গণতন্ত্র মঞ্চের শরিকরা

সাত রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত নতুন রাজনৈতিক জোট ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’ নিয়ে আশাবাদী এর উদ্যোক্তারা। তাদের মতে, ছোট শক্তিগুলো জনগণের দাবি নিয়ে সাহস করে একসঙ্গে বলিষ্ঠভাবে রাজপথে নামতে পারলে ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব। তবে নবগঠিত এই জোটকে খুব একটা আমলে নিতে নারাজ আওয়ামী লীগসহ ক্ষমতাসীন দলটির শরিকরা। তারা মনে করেন, বিগত নির্বাচনের আগেও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে সরকারবিরোধী এমন একটি জোট গঠিত হয়েছিল। কিন্তু কার্যত তারা কেবল ব্যর্থই হননি, ভোটের পরে চরম অন্তর্দ্বন্দ্বে নিজেরাই আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সোমবার নতুন রাজনৈতিক জোট হিসাবে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে গণতন্ত্র মঞ্চ। জোটভুক্ত দলগুলোর মধ্যে রয়েছে আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্য, সাইফুল হকের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জোনায়েদ সাকির নেতৃত্বাধীন গণসংহতি আন্দোলন, ড. রেজা কিবরিয়ার নেতৃত্বাধীন গণঅধিকার পরিষদ, রফিকুল ইসলাম বাবলুর নেতৃত্বাধীন ভাসানী অনুসারী পরিষদ এবং হাসনাত কাউয়ূমের নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান জানান দেওয়ার দিনই দেশে জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে এই জোট। আজ বৃহস্পতিবার তারা এই কর্মসূচি পালন করবে। একই দাবিতে এদিন যুগপৎভাবে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের কর্মসূচি পালন করবে বিএনপিও। মূলত বিএনপির সঙ্গে সমন্বয় করে যুগপৎভাবে রাজপথে সরকারবিরোধী সভা-সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে যাবে গণতন্ত্র মঞ্চ। তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী দিনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি আদায়ে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলা। গণতন্ত্র এবং মানুষের ভোটাধিকার দেশে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। জোটের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকারবিরোধী লড়াই-সংগ্রামের বিকল্প নেই। ষড়যন্ত্র নয়, প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েই সরকারবিরোধী আন্দোলনে যাবে ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’। নয়া এই জোটের রূপরেখায় বলা হয়, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা এবং অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য বর্তমান সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করতে হবে এবং একটি রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। ঘোষণায় আরও বলা হয়, রাষ্ট্রের তিন অঙ্গ-সংসদ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা এবং সরকারের জবাবদিহিতার কার্যকরী ব্যবস্থা গড়ে তোলা। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কার। এছাড়া গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা; মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের নীতিতে রাষ্ট্রের সব নাগরিকের জীবন ও মর্যাদা নিশ্চিত করা এবং দেশে ব্যাপক কর্মসংস্থান ও অর্থনীতির টেকসই প্রকৃতিবান্ধব ভিত্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সব জনগণের জন্য সমান সুযোগের নিশ্চয়তা তৈরি। গণতন্ত্র মঞ্চকে স্বাগত জানিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মোশাররফ হোসেন বুধবার যুগান্তরকে বলেন, দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য এই জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। দেশের এবং দেশের মানুষের চরম দুঃসময়ে তারা এগিয়ে এসেছেন, এজন্য আমরা তাদের সাধুবাদ জানাই। আশা করি, আমরা সবাই মিলে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আদায়ের মধ্য দিয়ে মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে পারব। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হব। তবে এই জোটকে খুব একটা আমলে নিতে নারাজ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে দলটির যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ এমপি বুধবার যুগান্তরকে বলেন, গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক দলগুলোর দেশব্যাপী সংগঠন নেই। ভোট নেই। জনসমর্থন নেই। জনসম্পৃক্ততাও নেই। এমনকি এই দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের অনেকের নিজস্ব নির্বাচনি এলাকাও নেই। আবার যাদের আছে, তাদের সেখানে ভোট নেই। মিডিয়ার কল্যাণে তারা বেঁচে আছেন, টিকে থাকেন। জনগণের কাছে এদের কোনো আবেদন নেই, গ্রহণযোগ্যতাও নেই। তিনি আরও বলেন, বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এই দলগুলো ভিন্ন নামে একটি জোট গঠন করেছিল। কিন্তু তাদের অতীত অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না। নির্বাচনে তারা কেবল ব্যর্থই হননি, ভোটের পরে চরম অন্তর্দ্বন্দ্বে নিজেরাই আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভাঙনের শিকার হয়েছে। তাই এই জোট নিয়ে এত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কিছু নেই। গণতন্ত্র মঞ্চের ভবিস্যৎ কী-এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম প্রধান শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি প্রবীণ বাম নেতা রাশেদ খান মেনন এমপি যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি তো মনে করি, এই জোট খুব একটা সফলতার মুখ দেখবে না। অতীত অভিজ্ঞতাও তাই বলে। বিগত নির্বাচনের সময়ও এদের মধ্যে কয়েকটি দল মিলে ড. কামাল হোসেনকে সামনে রেখে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে একটি জোট গঠন করেছিল, কিন্তু সুবিধা করতে পারেনি। এই জোটও খুব একটা সফলতার মুখ দেখবে না।’ সরকারি দল আর তাদের সমর্থকদের নেতিবাচক মন্তব্য সত্ত্বেও গণতন্ত্র মঞ্চের বিষয়ে আশাবাদ প্রকাশ করে এই জোটের অন্যতম উদ্যোক্তা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব যুগান্তরকে বলেন, আমরা এক ব্যক্তির পরিবর্তে অন্য ব্যক্তিকে কিংবা এক দলের পরিবর্তে আরেক দলকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য এই জোট গঠন করিনি। আমরা সরকারের পরিবর্তন যেমন চাই, তেমনই আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সমাজব্যবস্থারও আমূল পরিবর্তন চাই। সংবিধান এবং শাসনব্যবস্থারও আমূল পরিবর্তন চাই। এই চাওয়া বাস্তবায়নের জন্যই গণতন্ত্র মঞ্চ। আগামী দিনে আরও অনেক রাজনৈতিক দল এই জোটে সম্পৃক্ত হবে-এমন দাবি করে এই জোটের অন্যতম প্রধান শরিক দল গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক ড. রেজা কিবরিয়া যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার অবসানের জন্য আরও অনেক জোট হবে। আমাদের গণতন্ত্র মঞ্চেও আরও অনেক রাজনৈতিক দল যুক্ত হবে। পর্যায়ক্রমে একটি বৃহত্তর ঐক্য গড়ে উঠবে এবং এই ঐক্যের কারণে বর্তমান সরকারের পতন ঘটবে। গণতন্ত্র মঞ্চের আরেক উদ্যোক্তা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, ছোট শক্তিগুলো জনগণের দাবি নিয়ে সাহস করে একসঙ্গে বলিষ্ঠভাবে রাজপথে নামতে পারলে ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব। তিনি আরও বলেন, দেশের মানুষ বর্তমান সরকারের পরিবর্তন চায়। গণতন্ত্র এবং ভোটের অধিকার ফিরে পেতে চায়। আমরা এ লক্ষ্য নিয়েই একসঙ্গে জোট বেঁধেছি। আশা করছি, সবার সম্মিলিত চেষ্টায় সফল হব।