বছর শেষে স্কুলে ভর্তি সামনে রেখে বাণিজ্যে মেতে উঠেছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সরকারি ভর্তি নীতিমালায় অর্থ আদায়ের খাত ও পরিমাণ বলা আছকিন্তু এই দুটির কোনোটিই মানছে না ওইসব প্রতিষ্ঠান। নতুন নতুন সৃষ্ট খাত এবং বেনামেও ফি ধার্য করা হচ্ছে। এছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) অনলাইন আবেদনের ফল উপেক্ষা করে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাছাইয়ের নামে শিক্ষার্থী ভর্তি না করার অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অভিভাবকদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের কেউ শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) অভিযোগ জানাচ্ছেন। আবার কেউ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী ও সামাজিক সংগঠনেও অভিযোগ জানাচ্ছেন। এ অবস্থায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় সারা দেশে মোট ৭৯টি কমিটি গঠন করেছে। এছাড়া সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আমলে নিয়ে আরও ৪টি কমিটি গঠন করা হয়েছে। পাশাপাশি বিবৃতি দিয়েছে ক্রেতা-ভোক্তাদের জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় শাখা। অভিভাবক ফোরামও এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবার দেশের সব সরকারি এবং অধিকাংশ বেসরকারি স্কুল এবং স্কুল অ্যান্ড কলেজে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে অনলাইনে আবেদন নিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে শিক্ষার্থী ভর্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে লটারি করে শিক্ষার্থীকে প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল ও কলেজসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নির্বাচিত প্রার্থীদের কাগজপত্র দেখার নামে ভর্তি নিচ্ছে না বলে যুগান্তরে গত কয়েকদিন অসংখ্য ফোন এসেছে। প্রথম থেকে নবম পর্যন্ত প্রত্যেক শ্রেণির ক্ষেত্রে এমনটি করা হচ্ছে।
বুধবার খোদ শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের দায়ে অভিযুক্ত ১৩ প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ করা হয়। এতে দেখা যায়, ঢাকার মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়, গ্রীনফিল্ড স্কুল ও কলেজ, হোপ ইন্টারন্যাশনাল, চেতনা মডেল একাডেমি, মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউট অতিরিক্ত ফি আদায় করছে। এই তালিকায় আরও নাম এসেছে বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল ও কলেজ, শহীদ আনোয়ারা গার্লস স্কুল ও কলেজ, প্রিপারেটরি গ্রামার স্কুল, কসমো স্কুল। অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগ এসেছে ডেমরার সামসুল হক খান উচ্চ বিদ্যালয়, বনফুল গ্রিনহার্ট আদিবাসী কলেজ, এসওএস হারম্যান মেইনর কলেজ এবং পুলিশ স্মৃতি স্কুল ও কলেজের বিরুদ্ধে। এসব স্কুলের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় চারটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। প্রত্যেক কমিটিতে ৪-৫ জন করে সদস্য আছেন।
অন্যদিকে ক্যাবের চট্টগ্রামের নেতারা বুধবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, বৈশ্বিক করোনা মহামারি ও অর্থনৈতিক মন্দায় সাধারণ মানুষ যখন জীবন-জীবিকা নিয়ে কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন, তখন দেশের বিভিন্ন শহরের নামি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন ও নীতিমালা উপেক্ষা করছে। প্রতিষ্ঠানগুলো নামে-বেনামে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। বিবৃতিতে বলা হয়, ভর্তি ও পুনঃভর্তির নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নিয়মবহির্ভূতভাবে উন্নয়ন ফি, ডিজিটাল ফি, টিসি গ্রহণের সময় পুরো বছরের ফি আদায় করছে। এছাড়া নতুন সেশনে ভর্তির সময় নামে-বেনামে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ক্যাব নেতারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ধরনের বাণিজ্য বন্ধে অবিলম্বে প্রশাসনের পদক্ষেপ দাবি করেছেন।
ওই বিবৃতি এবং বিভিন্ন অভিযোগ পেয়েই বুধবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিজ্ঞপ্তি জারি করে। এতে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ওপর গঠিত চার কমিটিসহ মাউশির ঢাকা মহানগরীর ১৬টি মনিটরিং কমিটি, ৮টি বিভাগীয় মনিটরিং কমিটি এবং ৫৫টি জেলা মনিটরিং কমিটি কাজ করছে বলে উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি এতে এসব কমিটিকে সরেজমিন মনিটরিং করে মাউশিতে প্রতিবেদন পাঠাতে বলা হয়।
প্রসঙ্গত, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীক স্বাক্ষরিত ওই নীতিমালা গত ৮ ডিসেম্বর প্রকাশ করা হয়। এতে ১০ ও ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে ভর্তি ফির হার উল্লেখের পাশাপাশি বিধান না মানলে শাস্তির কথা লেখা আছে। ১০ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ২০১৬ সালে সরকার যে খাতগুলো নির্ধারণ করে দিয়েছে সেগুলোতেই কেবল অর্থ নেওয়া যাবে। বেসরকারি গ্রামাঞ্চলের স্কুলে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তির ফি সেশন চার্জসহ পাঁচশ টাকা। উপজেলায় এক হাজার, জেলা সদরে দুই হাজার এবং ঢাকা বাদে অন্য মেট্রোপলিটন এলাকায় তিন হাজার টাকার বেশি হবে না।
ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার এমপিওভুক্ত স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে পাঁচ হাজার টাকার অতিরিক্ত টাকা আদায় করা যাবে না। প্রতিষ্ঠান যদি আংশিক এমপিওভুক্ত (সব শিক্ষককে সরকার বেতন দেয় না) হয়, তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন এবং নন-এমপিও শিক্ষকদের বেতন-ভাতা দেওয়ার জন্য শিক্ষার্থী ভর্তির সময় মাসিক বেতন, সেশন চার্জ ও উন্নয়ন ফিসহ বাংলা মাধ্যমে সর্বোচ্চ আট হাজার টাকা এবং ইংরেজি ভার্সনে সর্বোচ্চ দশ হাজার টাকা নিতে পারবে। উন্নয়ন খাতে কোনো প্রতিষ্ঠান তিন হাজার টাকার বেশি নিতে পারবে না, যা আট বা দশ হাজার টাকার মধ্যেই সীমিত থাকবে। একই প্রতিষ্ঠানে বার্ষিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া শিক্ষার্থীর কাছ থেকে পরের ক্লাসে ভর্তির ক্ষেত্রে প্রতিবছর সেশন চার্জ নেওয়া যাবে। তবে পুনঃভর্তির ফি নেওয়া যাবে না। এবার আদায়ের খাতে সরকার নতুন একটা ফি আরোপ করেছে। সেটি হচ্ছে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্ট তহবিলের জন্য ভর্তির সময়ে শিক্ষার্থীপ্রতি ১০০ টাকা নিয়ে সংশ্লিষ্ট হিসাব খাতে জমা দিতে হবে।
উল্লিখিত বিধান না মানলে বা অতিরিক্ত টাকা আদায় করলে সরকার এমপিও বাতিলসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে বলে ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে।ে।
মন্তব্য