৫ ইসলামী ব্যাংক কেন ধার করছে

কোনো ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়লে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তারল্য সহায়তা দিয়ে থাকে। ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোকে ঋণের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে এ টাকা ধার দেয়াতারল্য সংকটে পড়া ৫টি শরীয়াহভিত্তিক ইসলামী ব্যাংককে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার বিশেষ ধার দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো হলো- ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল) ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক। এরমধ্যে ইসলামী ব্যাংক নিয়েছে ৮ হাজার কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ৩১২৫ কোটি টাকা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ১৫০০ কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংক ১৪৬৫ কোটি টাকা এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ৭০০ কোটি টাকা। যদিও শরীয়াহ ব্যাংকগুলোকে সুদের ওপর টাকা ধার নেয়ার সুযোগ নেই। কেননা, শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো সুদের পরিবর্তে মুনাফার ভিত্তিতে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে। নিয়মানুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিতে হলে ব্যাংকগুলোকে বিল, বন্ড লিয়েন রাখতে হয়। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ধার দিতে পারে না। কিন্তু তারল্য সংকটে থাকা এসব ব্যাংকগুলো নির্দিষ্ট অঙ্কের সুদের হারের ভিত্তিতে এই টাকা ধার করতে বাধ্য হয়েছে। এজন্য ৮.৭৫ শতাংশ সুদ গুনতে হয়েছে ব্যাংকগুলোকে। 

ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা গণমাধ্যমকে বলেন, গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে বিশেষ ব্যবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একদিনের জন্য টাকা ধার নিতে হয়েছিল।শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং রীতি অনুযায়ী মুনাফার ভিত্তিতে সেটা নেয়া হয়েছে, সুদে নয়। তিনি বলেন, গ্রাহকরা টাকা তোলার কারণে কিছুটা তারল্য ঘাটতি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। আশা করছি, আগামী এক-দুই সপ্তাহের মধ্যেই তারল্যের এই সমস্যা পুরোপুরি সমাধান হয়ে যাবে। জানা গেছে, সুকুক বন্ডের বিপরীতে ব্যাংকগুলো নির্ধারিত পরিমাণ টাকা ধার নিয়েছে। তার পরও ব্যাংকগুলো তারল্য সংকট কাটাতে পারছে না। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে নির্ধারিত নগদ জমা হার (সিআরআর) রাখতে শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে ‘প্রমিসারি ডিমান্ড নোট’ প্রদান করে টাকা ধার করতে হয় ব্যাংক ৫টিকে। এর মাধ্যমে যেকোনো উপায়ে টাকা ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় ব্যাংকগুলো। আর বাংলাদেশ ব্যাংক এক দিনের জন্য এ টাকা ধার দেয়, যার মাধ্যমে ব্যাংক ৫টি গত ২৯শে ডিসেম্বর বছরের শেষ কার্যদিবসে চাহিদা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অর্থ জমা রাখতে (সিআরআর) সক্ষম হয়।  ডিসেম্বর মাসের শুরুর দিকে ইসলামিক ব্যাংকস লিকুইডিটি ফ্যাসিলিটি নামে একটি বিশেষ তহবিলও গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক, যেই তহবিলের আওতায় এসব ব্যাংকে ১৪ দিন মেয়াদি তারল্য সুবিধা দেয়া হয়। সুবিধা চালুর দিন থেকেই ইসলামী ব্যাংকগুলো টাকা ধার নিয়েছে, কিন্তু তাতেও তাদের সংকটের সমাধান হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, কোনো ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়লে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তারল্য সহায়তা দিয়ে থাকে। ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোকে ঋণের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে এ টাকা ধার দেয়া হয়েছে। ডিমান্ড প্রমিজরি নোট অনুযায়ী, একদিনের মধ্যেই সুদসহ এরই মধ্যে ব্যাংকগুলো সে টাকা ফেরত দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী, ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোকে আমানতের সাড়ে ৫ শতাংশ এসএলআর ও ৪ শতাংশ সিআরআর রাখতে হয়। প্রচলিত ব্যাংকগুলোর জন্য দু’টি মিলে যা হয় ১৭ শতাংশ। তবে বর্তমানে তারল্য সংকটের কারণে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোকে দৈনিক ভিত্তিতে আমানতের ন্যূনতম সাড়ে ৩ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দিতে হয়। আর দ্বি-সাপ্তাহিক ভিত্তিতে জমা রাখতে হয় ৪ শতাংশ অর্থ। চাহিদা অনুযায়ী জমা রাখতে ব্যর্থ হলে গুনতে হয় জরিমানা। 

সংশ্লিষ্টদের মতে, এসব ব্যাংক নামে-বেনামে আগ্রাসী বিনিয়োগ করেছে, যা আদায় হচ্ছে না। সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংকে ঋণ বিতরণে অনিয়মের একাধিক অভিযোগ প্রকাশ হওয়ার পর ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নেয়ার হিড়িক শুরু হয়। অক্টোবর মাসের শেষে ইসলামী ব্যাংকে আমানত ছিল ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা, এখন এসে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকায়। এর ফলে ব্যাংকগুলোতে সংকট তৈরি হয়েছে। এরমধ্যে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক; দেশের ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর অন্যতম অর্থ জোগানদাতাও। এই ব্যাংকটি তারল্য সংকটে পড়ায় অন্য ইসলামী ব্যাংকগুলোও একই সংকটে পড়েছে। এর আগে পদ্মা ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংককেও একই ধরনের সুবিধা দেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মতে, বাংলাদেশে ব্যাংকের যেসব আইনকানুন রয়েছে, তাতে প্রচলিত সুদের আওতায় ইসলামী ব্যাংকগুলোকে টাকা ধার দেয়া যায় না। ফলে জরুরি চাহিদার প্রেক্ষাপটে একদিনের জন্য স্পেশাল নির্ধারিত রেটে ইসলামী ব্যাংকগুলোকে টাকা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে সেখানে শরীয়াহভিত্তিক ব্যবস্থায় মুনাফা দেয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংক নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে, যাতে কোনো গ্রাহককে টাকা তুলতে এসে ফিরে যেতে না হয়। এ কারণে চড়া সুদে ধার নিয়ে হলেও গ্রাহক সেবা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছে ইসলামী ব্যাংক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইসলামী ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আস্থার সংকট তৈরি হওয়া। সেই কারণেই সাধারণ গ্রাহকরা এসব ব্যাংক থেকে টাকা তুলে অন্য ব্যাংকে নিয়ে যাচ্ছেন। সাবেক ব্যাংকার মো. নুরুল আমিন বলেন, ইসলামী ব্যাংকগুলো ফিক্সড রেটে লেনদেন করতে পারে না, কারণ মুনাফা তো ফিক্সড হতে পারে না। এক্ষেত্রে কিন্তু ফিক্সড রেট বেঁধে দেয়া হয়েছে। ফলে বুঝতে পারা যায়, এসব ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ব্যাংক- উভয়েই বেশ বাধ্য হয়ে এই পথ বেছে নিয়েছে। তিনি বলেন, ঋণ অনিয়ম নিয়ে নানা ধরনের খবর প্রকাশের কারণে সাধারণ গ্রাহকদের আস্থা কমে গেছে। ফলে তারা অনেকেই টাকা তুলে অন্য ব্যাংকে নিয়ে গেছেন। একসাথে অনেক গ্রাহক টাকা তোলার চেষ্টা করায় এই তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে। এখন এই সংকট সমাধানের পথ বের করতে হবে বলে জানান তিনি।