ডলারের দাম আরও বাড়াতে হবে

দীর্ঘদিন ডলারের বিনিময় হার কৃত্রিমভাবে ধরে রাখার খেসারত এখন দিতে হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুরতার মতে, এতদিন টাকার মান ৪০ শতাংশ অতিমূল্যায়িত ছিল। ডলার সংকট শুরু হওয়ার পর ২৫ শতাংশের মতো টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। আরও ১৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

শনিবার ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের ‘আইএমএফ-এর ঋণ : ভোগ করবে কে, পরিশোধ করবে কে?’ শীর্ষক ওয়েবিনারে এসব কথা বলেন আহসান এইচ মনসুর। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ব্যাংক ঋণের সুদহার বেঁধে রাখার কারণে ক্ষুুদ্র ও মাঝারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কাঙ্ক্ষিত হারে ঋণ পাচ্ছে না। বড়রা সব পেয়ে যাচ্ছে, তাও আবার কম সুদে। সব দিক থেকেই তারা লাভবান হচ্ছে। তেল, চিনি থেকে শুরু করে আমদানি পণ্যের দাম বাড়লেও তারা লাভবান হচ্ছে। এভাবে বড়রা লাভবান হওয়ার কারণে সমাজে যেমন বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। একটি শ্রেণির হাতে অর্থ-সম্পদ পুঞ্জীভূত হওয়ায় তারা ফুলেফেঁপে উঠলেও সরকারের রাজস্ব বাড়ছে না বরং প্রতিবছরই তা কমছে। সে কারণে জিডিপির অনুপাতে সরকারি ব্যয় কমে যাচ্ছে, বঞ্চিত হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকারের পলিসিগত সমন্বয়হীনতা লক্ষ করা যাচ্ছে। অর্থমন্ত্রীর এটা দেখার কথা। তিনি কোথায়? তাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না কেন? আদানির সঙ্গে চুক্তি হলো। এর সারমর্ম কি জানি? সরকারের তরফে জানানো হলো-এটা গোপন চুক্তি। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় গোপন চুক্তির কি কোনো সুযোগ আছে? জনগণের টাকা খরচ হবে গোপন চুক্তিতে। জনগণ তা জানতেও পারবে না। এটা কী করে সম্ভব। জনগণের কাছে যে দায়বদ্ধতা তার অনুপস্থিতি কিছুতেই কাম্য নয়। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ও দৈনিক প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন। আনু মুহাম্মদ বলেন, আইএমএফের শর্ত পূরণ হলে দেশের অর্থনীতির ভালো হবে, এটা এক ধরনের ‘উইশফুল থিঙ্কিং’ বা মন বলে সত্য, কাজেই তা সত্য-এমন বিষয়। বাংলাদেশ এর আগে ১২ বার আইএমএফের ঋণ নিয়েছে, কিন্তু তারপরও দেশে কর-জিডিপির অনুপাত বাড়েনি বরং কমেছে। আইএমএফ থেকে ১৬ বার ঋণ নিয়েছে শ্রীলংকা। পাকিস্তান নিয়েছে ২২ বার। বর্তমানে শ্রীলংকা এবং পাকিস্তানের আর্থিক অবস্থা খুবই নাজুক। তার মানে আইএমএফ থেকে যে যত বেশি ঋণ নিয়েছে সে তত বেশি বিপদে পড়েছে।

তিনি আরও বলেন, আইএমএফ এবার শর্তের বিষয়ে অতটা আন্তরিক নয়। তাদের শর্তে খেলাপি ঋণ কমানোর কথা বলা আছে। ব্যাংক খাত সংস্কারের কথাও আছে। কিন্তু এসবের সঙ্গে বড় গোষ্ঠী জড়িত। সরকার তাদের কিছুই করতে পারে না। পাশাপাশি ভর্তুকি কমাতেও বলা হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত সাধারণ মানুষ। বড়দের সঙ্গে কিছু করতে না পারলেও দফায় দফায় বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে সাধারণ জনগণের কষ্ট এবং বোঝা উভয় বেড়েছে।

আনু মুহাম্মদ বলেন, কয়েকটি গ্রুপ রাতারাতি বেশ কিছু ব্যাংকের মালিক হয়ে গেল। হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করছে। কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াই ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হচ্ছে। এর সুবিধাভোগী তারা নিজেরাই। অন্যদিকে দেশের জ্বালানি খাত পুরোপুরি আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে। সরকারের ভুল নীতির কারণে তা হচ্ছে, কিন্তু আইএমএফ এ বিষয়ে একটি কথাও বলে না। আইএমএফ আন্তর্জাতিক পরিসরে বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বার্থ রক্ষা করে।

আইএমএফের শর্তের কারণে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ে-এ বিষয়ে আনু মুহাম্মদের সঙ্গে একই সুরে কথা বলেন শওকত হোসেন। তার অভিযোগ, পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, আইএমএফ সবার ওপর একই ধরনের শর্তারোপ করে। এটা সাধারণ মানুষকে ভোগাবে। বিদ্যুতের দাম এক মাসে তিনবার বাড়ানো হয়েছে। শেষ পর্যন্ত উচ্চ মূল্যস্ফীতির মাধ্যমেই এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। সেজন্য তারা বিশ্বের সবচেয়ে অজনপ্রিয় ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান।

আইএমএফের কাছে ঋণের আবেদন করার কারণ অর্থনৈতিক। এটা রোগের লক্ষণ বলে মনে করেন ড. বদিউল আলম মজুমদার। তার মতে, রোগটা হলো গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতার অভাব, জনগণের কাছে দায়বদ্ধতার অভাব।

এ সংসদকে ‘তথাকথিত নির্বাচিত সংসদ’ বা পাতানো সংসদ হিসাবে আখ্যা দিয়ে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, প্রকৃত নির্বাচন করতে হলে পাঁচ বছর পরপর হলেও জনগণের কাছে যেতে হয়। কিন্তু তা হচ্ছে না বলে যারা সরকারকে ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করছে, সরকার তাদেরই তুষ্ট করছে, অর্থাৎ বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলো। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন মনির হায়দার। অনুষ্ঠানে দেশ ও বিদেশ থেকে বিশ্লেষক ও সাংবাদিকরা যোগ দেন।।