অভাবের থাবায় ‘কঙ্কাল’ মিশরের ‘রহমতের টেবিল’

চরম অর্থনৈতিক সংকটে দিন যাচ্ছে মিসরের। বেশ কয়েক বছর ধরেই এ অবস্থা। মানুষের হাতে টাকা নেই। ডলারের বিপরীতে নেমে গেছে মিসরীয় পাউন্ডের মানরাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সৃষ্ট চলমান বৈশ্বিক মন্দা, মুদ্রাস্ফীতিসহ জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে কৃষি উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। দানবীয় আকার ধার করেছে খাদ্যপণ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি। যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে শত শত বছর ধরে চলে আসা মিসরের ঐতিহ্যবাহী ‘রহমতের টেবিলে’ (মার্সি টেবিল)। 

সাধারণ পথচারী এবং অভাবী মানুষের বিনামূল্যে ইফতার টেবিল। রমজান এলেই পাড়া-মহল্লা-শহরের রাস্তায় রাস্তায় লম্বা টেবিলে বিনিপয়সার ইফতারির এ ‘রহমতের টেবিল’ দেশটিতে ঈদের আনন্দের মতোই আরেকটি উৎসবমুখর সংস্কৃতি। রমজান আসার আগে থেকেই ধনাঢ্য ব্যক্তি, দাতব্য সংস্থাগুলো মুখিয়ে থাকে এই আনন্দে অর্থায়নের জন্য। কিন্তু এবারের চিত্রটা একেবারেই ভিন্ন। অভাবের থাবায় ‘কঙ্কাল’ হয়ে গেছে জমকালো রহমতের টেবিল! কমে গেছে ইফতারির পদ। আগের দিনগুলোর মতো আর অলিতে-গলিতে চোখে পড়ছে না ৫০ হাত বা ১০০ থেকে ২০০ হাত দৈর্ঘ্যরে লম্বা টেবিল! খবর এএফপির। 

পেশায় বিয়ে বাড়িতে রান্নার বাবুর্চি ইসমাইল আল-হুসেইনি (৪৬) বলেন, প্রতি বছর রমজানেই আমি এই কাজ থেকে বিরতি নিয়ে রাজধানী কায়রোতে এবং তৃতীয় বৃহত্তম শহর গিজাতে সারা মাসের রহমতের টেবিলের রান্নার বুকিং নেই। তবে এই রমজানে দেশটির অর্থনৈতিক সংকট আমার ব্যবসাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। 

তিনি আরও বলেন, আমি গত ১৫ বছর ধরে এই কাজটি করছি। এই বছরই প্রথম আমি পুরোপুরি বুকিং পাইনি। এটি শত শত অভাবী মানুষের জন্য বিনামূল্যে রান্না করা খাবারের সুযোগ ছিল। যা এবার হ্রাস পেয়েছে। 

তিনি আরও বলেন, মিসরে রহমতের টেবিলের সংখ্যা এবার ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এখানে যারা দান করে খাদ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির কারণে তারা সহায়তা কমিয়েছেন। একটি মার্সি টেবিল এক বসায় ২৫০০ মানুষকে খাওয়ানো যেতে পারে। কখনো কখনো আরও বেশি। কিন্তু এ বছর রমজানে এই চিত্র ভিন্ন। সামান্য কিছু মানুষের খাবার আয়োজন করা হচ্ছে টেবিলগুলোতে। 

রহমতের টেবিলের ইফতারে যাওয়ার জন্য লাইনে অপেক্ষা করা এক গৃহিণী সাইয়েদা জেইনাব বলেন, আমি দাতব্য লাইনে দাঁড়ানো আমার পরিচিত অনেক লোককে দেখি। কিন্তু আমি নিকাব (হিজাব) পরেছিলাম। কারণ কেউ যেন আমাকে চিনতে না পারে। আমি এমন করেছি কারণ আমার সন্তানরা যেন লজ্জার মুখে না পড়ে। মোহাম্মদ নামের একজন বলেন, আমি আমার স্ত্রী-সন্তানকে মার্সি টেবিলে নিয়ে যাই। অন্যথায় ইফতারে আমাদের শুধু মাত্র রুটি এবং পনির খেতে হবে। 

মার্সি টেবিল হোস্টিং নামের একটি দাতব্য সংস্থার কর্মী সাইদ জেনিশ বলেন, টেবিলগুলো সঠিকভাবে পরিচালনা করতে সরকার থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থার অনুমোদন এবং লাইসেন্স প্রয়োজন। মুনাফার উদ্দেশ্যে নয়, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশাতেই আমরা এই মানবিক সহায়তা করি। আমি আশা করি সরকার সাধারণ মানুষের জীবনকে সহজ করে তুলবে। 

মিসরের দৈন্যদশার আরেকটি দৃশ্যও এবার ফুটে উঠেছে এ বছরের টেবিলে। অসহায়-নিম্নবিত্তের ভিড় বেড়েছে। মুখ ঢেকে, মাথা লুকিয়ে ইফতারের লাইনে দাঁড়িয়েছে শিক্ষিত-মধ্যবিত্তরাও। 

টেবিল হোস্টিংয়ের অন্য এক কর্মী ইয়াসির (৫৫) বলেন, আগের বছরগুলোতে জনগণ মাগরিবের নামাজের এক ঘণ্টা আগে থেকেই জায়গা নিয়ে বসে থাকত। এখন তারা ৩ ঘণ্টা আগে আসে। এমনকি এই বছর যুবক, স্যুট পরা পুরুষ এবং ভালো পোশাক পরা মহিলারাও খাবার পেতে লাইনে দাঁড়িয়েছে। যা এর আগে কখনো হয়নি। 

চলতি বছরের শুরুতে মিসরীয় পাউন্ডের অবমূল্যায়নের পর থেকে বেশির ভাগ আমদানি করা খাদ্যসামগ্রীর দাম দ্বিগুণেরও বেশি পরিমাণে বেড়েছে। 

গত সপ্তাহে পাউন্ডপ্রতি ডলারের মূল্য ছিল ৩৫.৫-৩৬। ফেব্রুয়ারিতে মুদ্রাস্ফীতির হার পৌঁছেছে ৪০ শতাংশে। মিসরের ১০ কোটি ৪০ লাখ জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশির ভাগ মানুষের ওপরই পড়েছে এর ভয়ংকর প্রভাব।