গত প্রায় এক বছর ধরে সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি একটি নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তুলনামূলকভাবে কোথাও কম, কোথাও বেশি। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্রমাগত নীতি সুদহার বাড়মূল্যস্ফীতির চাপ কমলেও তিনটি ব্যাংক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে-সোজা কথায় বন্ধ হয়ে গেছে। তবে এসব ব্যাংক ততটা বড় ছিল না। অন্য বৃহৎ ব্যাংক এদের কিনে নিয়েছে। সে দেশের উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের গতি কমেছে এবং ভোগ চাহিদায় টান পড়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৯-১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি পর্যায়ক্রমে ৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যেমন-যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, ডেনমার্ক, নরওয়ে ইত্যাদি দেশেও মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের উপর থেকে বর্তমানে ৫-৭ শতাংশে নেমে এসেছে।
২০২৩ সালের এপ্রিলে জার্মানির মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ, ডেনমার্কের ৫ দশমিক ৩ শতাংশ, ফ্রান্সে ৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ, ইতালিতে ৮ দশমিক ১ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে ভোক্তামূল্য সূচক অনুযায়ী হার ১০ দশমিক ১ শতাংশ, তবে বার্ষিক হার ৫.৭ শতাংশ, নেদারল্যান্ডসের মূল্যস্ফীতির হার ৪ দশমিক ৪ শতাংশ, স্পেনের ৬ দশমিক ৬ শতাংশ, নরওয়ের মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। বর্তমানে এশিয়া ও ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি তুরস্কে-৪৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ, হাঙ্গেরিতে ২৫ দশমিক ৮ শতাংশ, লাটভিয়ায় ২০ দশমিক ১ শতাংশ, চেক প্রজাতন্ত্রে ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ।
ভারতের গত মাসের মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ, পাকিস্তানের কোর মূল্যস্ফীতির হার ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ। সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতিতে আর্জেন্টিনা সম্ভবত সর্বোচ্চ-এপ্রিলে ১০৮ দশমিক ৮ শতাংশ। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ইত্যদি দেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভালো অবস্থানে রয়েছে (৩-৪ শতাংশ)।
বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি গত বছর আগস্টে সাড়ে ৯ শতাংশে উঠেছিল, যা ছিল গত ১১ বছরে সর্বোচ্চ। তারপর থেকে ৮-৯ শতাংশে ওঠানামা করেছে। এ বছর এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি আবার বেড়ে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তবে বেসরকারি থিংক ট্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, খাদ্য মূল্যস্ফীতি ২০ শতাংশ অতিক্রম করেছে। জ্বালানি মূল্যস্ফীতি আরও বেশি। এবারের মূল্যবৃদ্ধির আরও একটি বৈশিষ্ট্য হলো-শহরের চেয়ে গ্রামের মূল্যস্ফীতি বেশি। এর প্রধান কারণ শহরে দ্রব্যাদির সরবরাহ ও চাহিদা উভয়ই বেশি।
শ্রীলংকা ও পাকিস্তান বাদে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি এখন সর্বোচ্চ। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাস, সার, খাদ্যশস্য, ভোজ্যতেল ইত্যাদির যে দাম, সে তুলনায় আমাদের দেশের বাজারমূল্য অনেক বেশি। গত সপ্তাহের বাজারদর অনুযায়ী মোটা চাল প্রতি কেজি ৪৬-৫০ টাকা, সরু চাল কেজিপ্রতি ৬৫-৭০ টাকা, ডিমের হালি ১২০-১৪০ টাকা, প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয় ২২০-২২৫ টাকায়, গরুর গোশত ৭৫০-৮০০ টাকা কেজি, বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি কেজি ১৯৯ টাকা। চিনি বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ১৩০-১৪০ টাকায়, অথচ চিনি আমদানিতে শুল্ক মওকুফ ছিল। আদা, পেঁয়াজ, রসুনের দাম আবার নতুন করে বেড়েছে। পেঁয়াজ প্রতি কেজির খুচরা মূল্য ৮০ টাকা। যে কোনো ধরনের সবজি গড়ে প্রতি কেজি ৬০-৮০ টাকায় বিক্রি হয়। গুঁড়া দুধের দাম বেড়েছে লাফিয়ে।
ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্য এবং উৎপাদনের উপকরণের দামও বেড়েছে। ফলে উৎপাদিত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি, টয়লেট্রিজ, ওষুধসামগ্রী ইত্যাদির দাম বেড়েছে। সেবা খাতে প্রতিটি আইটেম, যেমন-বিমান ভাড়া, বাস ভাড়া, হাসপাতাল ও ডাক্তারের খরচ, হোটেল ভাড়া ইত্যাদিও বেড়েছে। বাজারে লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের কারণে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের সংকট বেশি। বিভিন্ন খাতে তারা ব্যয় সংকোচন শুরু করেছে। এমনকি সন্তানদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নিয়মিত খাদ্য গ্রহণেও কাটছাঁট করতে হচ্ছে।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে হয়, দেশে কোনো খাদ্য সরবরাহ চেইনে সংকট নেই। বিশ্ববাজারে দ্রব্যমূল্য কমতির দিকে। দেশে কৃষি উৎপাদন ভালো হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়নি। দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে, দরিদ্রদের সহায়তায় ও কষ্ট লাঘবে এবং শিল্প-কারখানায় উৎপাদন অব্যাহত রাখতে সরকারি প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। টিসিবির মাধ্যমে গরিব মানুষের মধ্যে চাল, ডাল, তেল, চিনি ইত্যাদি ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে। সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও কৃষিতে ভর্তুকি অব্যাহত রয়েছে। তবুও কেন বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না? বিশেষজ্ঞদের অভিমত, আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতি শুধু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কিংবা বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির কারণে হচ্ছে না, এর পেছনে রয়েছে কিছু অসৎ ব্যবসায়ীর কারসাজি এবং অতি মুনাফাখোরি প্রবণতা। চাল, ডাল, তেল, চিনি ইত্যাদির বাজার নিয়ন্ত্রণ করে গুটিকয়েক ব্যবসায়ী। উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণেও সরকারি নিয়ন্ত্রণ নেই। শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের মধ্যে অনেকটা কার্টেল করে মূল্য নির্ধারণ করে। বাজারের এ সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে কিংবা কঠোরভাবে মনিটর না করা হলে দেশে দ্রব্যমূল্য কমবে না। সেজন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে দক্ষ ও কৌশলী হতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে অসৎ ব্যবসায়ীরা যেন রাজনৈতিক কিংবা প্রশাসনিক আশ্রয়-প্রশ্রয় না পায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, টিসিবি, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ, প্রতিযোগিতা কমিশন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানসহ সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। সবজি, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, ইত্যাদি কৃষিজ দ্রব্যে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমানোর প্রচেষ্টা নিয়ে কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। সড়কে চাঁদাবাজি, পাইকারি ও খুচরা বাজারে বিভিন্ন সংগঠন ও একশ্রেণির আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের চাঁদাবাজি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশের বর্তমান অব্যাহত অগ্রগতি, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন, বাণিজ্য বৃদ্ধি, উৎপাদন বৃদ্ধি, ভোগ চাহিদা, সরকারি ব্যয় ইত্যাদি বৃদ্ধির মাধ্যমে এ দেশ নিম্নআয়ের দেশ থেকে উন্নয়নশীল মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হয়েছে। আমাদের অগ্রযাত্রা এখন সারা বিশ্বে স্বীকৃত। কিন্তু বর্তমান মূল্যস্ফীতি তথা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষ উন্নয়নের ফল ভোগ করতে পারছে না। অনেকের কাছে এ উন্নয়ন অর্থহীন হয়ে পড়ছে। সেজন্য সরকার, ব্যবসায়ী, সুশীল সমাজ, রাজনীতিক-সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় মূল্যস্ফীতির প্রকোপ কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে।
মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া : সাবেক সিনিয়র সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান, বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত
মন্তব্য