ঘাটতি ৮৮০ কোটি ডলার

ফাইল ছবি

দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমছে। উন্নতি হয়েছে চলতি হিসাবের ঘাটতি পরিস্থিতিতেও। তবে আর্থিক হিসাব এবং পুঁজিবাজারে নেতিবাচক ধারা অব্যাহত। এছাড়া আগে নেওয়া ঋণ পরিশোধের তুলনায় নতুন ঋণ কম আসছে। ফলে সামগ্রিকভাবে দেশের আর্থিক হিসাবে বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে যেখানে এ ঘাটতি ছিল ৫৫৯ কোটি ডলার। সেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৮৮০ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের (২০২২-২৩) জুলাই-মে সময়ের ব্যালান্স অব পেমেন্ট বা বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতেই ঘাটতির বিষয়টএ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থনীতির বিশ্লেষক ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর যুগান্তরকে বলেন, কয়েকটি ব্যাংক সময়মতো আমদানির দায় পরিশোধ করেনি। এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এছাড়া অপর্যাপ্ত বিনিয়োগ পরিবেশ এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তো আগে থেকেই আছে। এর সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে আন্তর্জাতিক ঋণ মান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান মুডিস রেটিং। এ রেটিংয়ে বাংলাদেশ অনেকখানি পিছিয়ে গেছে।

জানা গেছে, সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যের ঘাটতি মানে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হচ্ছে। বিভিন্ন উৎস থেকে দেশে যে অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা আসছে, পরিশোধ হচ্ছে তার চেয়ে বেশি। এ অবস্থায় দেনা পরিশোধের ঝুঁকি এড়াতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে গত অর্থবছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সাড়ে ১৩ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২১-২২ অর্থবছর বিক্রি করে আরও ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।

এভাবে বিক্রির ফলে ক্রমেই রিজার্ভ কমে আসছে। সর্বশেষ গত ২৫ জুন পর্যন্ত রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩০ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলারে। গত বছরের জুনে যা ছিল ৪০-৪২ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করে ২০২১ সালের আগস্টে। করোনা-পরবর্তী অর্থনীতিতে বড় চাহিদা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়েছে। যার প্রভাব পড়েছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর। এর নেতিবাচক প্রভাবে দেশে মার্কিন ডলারের দামও হুহু করে বাড়তে থাকে।

বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে চাপ কাটাতে নানা উপায়ে আমদানি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। গত বছরের জুলাই থেকে বিভিন্ন পণ্য আমদানির শুল্ক বাড়িয়েছে সরকার। আবার তুলনামূলক কম প্রয়োজনীয় পণ্যের এলসি খোলার সময় ৭৫ থেকে শতভাগ পর্যন্ত নগদ মার্জিনের শর্ত দেওয়া হয়েছে। এই মার্জিনের টাকা আবার কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া যাবে না। এছাড়া বড় এলসি খোলার ২৪ ঘণ্টা আগে তথ্য নিয়ে এর সঠিকতা যাচাই করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ডলার সংস্থান ছাড়া ব্যাংকগুলোকে এলসি না খুলতে বলে দেওয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগের ফলে আমদানি কমছে। অবশ্য নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার কারণে বড় আমদানিকারকদের তুলনায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি আমদানিকারকরা বেশি প্রভাবিত হচ্ছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৬ হাজার ৪৭৬ কোটি ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় যা ১৪ দশমিক ১১ শতাংশ কম। গত অর্থবছরের রপ্তানি ৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ বেড়ে ৪ হাজার ৭৬০ কোটি ডলার হয়েছে। অন্যদিকে একই সময়ে ১ দশমিক ১৪ শতাংশ বেড়ে ১৯৪১ কোটি ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। এতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে চলতি হিসাবের ঘাটতি কমে ৪৫০ কোটি ডলারে নেমে আসে। ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে যেখানে ঘাটতি ছিল ১৭২৭ কোটি ডলার। তবে বিভিন্ন সময়ে নেওয়া বিদেশি ঋণ যে হারে পরিশোধ করতে হচ্ছে, নতুনভাবে আসছে তার চেয়ে কম। এতে আর্থিক হিসাবে বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। সাধারণভাবে আর্থিক হিসাব সব সময় ইতিবাচক থাকে। তবে বিদায়ি অর্থবছরে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৫৮ কোটি ডলার। তার আগের অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে যেখানে উদ্বৃত্ত ছিল ১ হাজার ৩৩৭ কোটি ডলার। আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত থেকে ঘাটতি পরিস্থিতি সামগ্রিক বৈদেশিক মুদ্রা খাতকে চাপে রেখেছে। বিদায়ি অর্থবছরের মে পর্যন্ত সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি হয়েছে ৮৮০ কোটি ডলার। যেখানে আগের অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল ৫৫৯ কোটি ডলার।

বিদায়ি অর্থবছরের মে পর্যন্ত দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে ৪৬২ কোটি ডলার। যা আগের অর্থবছর একই সময়ে ছিল ৪২৬ কোটি ডলার। এফডিআই বেড়েছে ৮ দশমিক ২৭ শতাংশ। তবে এ সময়ে নিট এফডিআই বা বিদেশি বিনিয়োগ কিছুটা কমেছে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে সরাসরি মোট যে বিদেশি বিনিয়োগ আসে তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ নিয়ে যাওয়ার পর যেটা অবশিষ্ট থাকে সেটাকে নিট এফডিআই বলা হয়। সূচকটি সদ্য বিদায়ি অর্থবছরে ৭ দশমিক ০৩ শতাংশ কমে ১৬৩ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। আগের অর্থবছর একই সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ১৭৬ কোটি ডলার। একইসঙ্গে পুঁজিবাজারেও বিদেশি বিনিয়োগে নেতিবাচক অবস্থা অব্যাহত আছে। গত মে পর্যন্ত পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ (নিট) যা এসেছিল তার থেকে ৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার চলে গেছে। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল (ঋণাত্মক) ১৩ কোটি ৫০।