ডলার সংকটের মধ্যে বিভিন্ন খাতে এর দাম বেঁধে দিয়েও নির্ধারিত সীমার মধ্যে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। অনেক ব্যাংক নির্ধারিত সীমার চেয়ে বেশি দামে রেমিট্যান্স কিনছে, আমদানির বিল পরিশোধের ক্ষেত্রেও বেশি দাম নিচ্ছে। এমনকি ব্যাংকগুলো বিভিন্ন খাতে ডলার কেনাবেচার যে দর ঘোষণা করছে, সেই দরের চেয়ে বেশি দামে ডলার কেনাবেচা করছে। বাড়তি দর ব্যাংকগুলো অন্যভাবে সমন্বয় এতে একদিকে ব্যাংকের ডলার কেনার খরচ বাড়ছে, এ কারণে তারা বাধ্য হয়ে বেশি দামে বিক্রি করছে। এতে আমদানি খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এর প্রভাবে বাড়ছে আমদানিসহ প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম, যা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে। চাপ সৃষ্টি করছে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের দুটি সংগঠনের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। সূত্র জানায়, ডলারের বিপরীতে টাকার মানকে ২০০৩ সালের মে মাস থেকে বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। ওই সময়ের পর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর ঘোষণা দিয়ে ডলারের দাম নির্ধারণ করছে না। বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে এর দাম নির্ধারিত হচ্ছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পরোক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করত। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের শর্তের কারণে এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারছে না।
আইএমএফ ডলারের দামকে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার চাপ দিচ্ছে। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) মাধ্যমে ডলার বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। গত বছরের অক্টোবর থেকে বাফেদা ও এবিবি বৈঠক করে ডলারের দাম নির্ধারণ করছে। ওই দামেই ব্যাংকগুলোকে ডলার কেনাবেচা করার কথা।
কিন্তু অনেক ব্যাংক ডলারের তীব্র সংকটে পড়ে এর চেয়ে বেশি দামে বেচাকেনা করছে। ২৬ জুন এবিবি ও বাফেদা বৈঠক করে ডলারের নতুন দাম নির্ধারণ করে। সে অনুযায়ী ২ জুলাই থেকে রেমিট্যান্সে সর্বোচ্চ ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা, রপ্তানি বিল কেনায় সর্বোচ্চ ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা এবং আন্তঃব্যাংকে সর্বোচ্চ ১০৯ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। নতুন দর কার্যকর হওয়ার আগেই গত জুনে আমদানিতে ডলারের দাম সর্বোচ্চ ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা ছাড়িয়ে যায়। ২ জুলাই নতুন দাম কার্যকর হওয়ার পর ব্যাংকগুলোর ডলার কেনার খরচ বেড়ে যায়। ফলে তারা আমদানিতে এর দাম আরও বাড়িয়ে ১১০ টাকার কাছাকাছি নিয়ে যায়।
এ পরিপ্রেক্ষিতে ৩ জুলাই বাফেদা থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় একটি চিঠি দিয়ে বলা হয়, ডলারের ক্রয় ও বিক্রয়মূল্যের মধ্যকার পাঁচ দিনের গড় হিসাবে যে ব্যবধান হবে, এর সঙ্গে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আমদানি ও আন্তঃব্যাংকে ডলার বিক্রির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১ টাকা যোগ করতে পারবে। তবে দুই খাতেই ডলারের দাম কোনোক্রমেই ১০৯ টাকার বেশি নেওয়া যাবে না। অর্থাৎ এখন থেকে আমদানিতেও ডলারের দাম ১০৯ টাকার বেশি হবে না। অথচ এ খাতে ডলারের দাম ১১০ টাকার কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। ওই চিঠি ইস্যুর পর ব্যাংকগুলো আমদানিতে ডলারের দাম সর্বোচ্চ ১০৯ টাকা ঘোষণা করলেও বাস্তবে কোনো কোনো ব্যাংক ১১২ থেকে ১১৪ টাকাও নিচ্ছে।
বিশেষ করে রেমিট্যান্সও তারা বেশি দামে কিনছে। কোনো কোনো ব্যাংক ১১২ টাকা করে রেমিট্যান্স কিনছে। ফলে তাদের ডলার কেনার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এতে বিক্রিও করতে হচ্ছে বেশি দামে। ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন কোনো কোনো ব্যাংক ১১৩ থেকে ১১৪ টাকা করেও আমদানিতে ডলারের দাম রাখছে। ঢাকার বাইরে ১২২ টাকা করেও আমদানিতে ডলার বিক্রি হচ্ছে। তবে ব্যাংকগুলো বাড়তি টাকা ডলারের দাম হিসাবে না নিয়ে অন্য খাতে সমন্বয় করছে।
বাফেদার এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের অনেকেই দ্বিমত পোষণ করেছেন। তারা বলেছেন, আন্তঃব্যাংকে ডলারের দাম এখন সর্বোচ্চ সীমা ১০৯ টাকায় উঠেছে। বাধার কারণে এর বেশি বাড়তে পারছে না। এক টাকা কমিশন নেওয়ার বিধান থাকলেও সর্বোচ্চ দামের কারণে এটি নেওয়া সম্ভভ হচ্ছে না। কারণ, কোনোক্রমেই আন্তঃব্যাংকের এর দাম ১০৯ টাকার বেশি হবে না। তবে আন্তঃব্যাংকে ডলার বেচাকেনা হচ্ছে খুবই কম। সব ব্যাংকেই ডলার সংকট থাকায় আন্তঃব্যাংকে কেউ বিক্রি করছে না। মাঝেমধ্যে কিছু বিক্রি হলেও তা সর্বোচ্চ দরেই হচ্ছে।
ফলে ব্যাংকের পক্ষে ফি আরোপ করা সম্ভব হচ্ছে না। আন্তঃব্যাংক থেকে ১০৯ টাকা দরে ডলার কিনে আমদানির বিল পরিশোধে তা গ্রাহকের কাছে ১০৯ টাকা দরেই বিক্রি করতে হবে। কারণ, এ খাতে ১০৯ টাকার বেশি নেওয়া যাবে না। ফলে এক্ষেত্রে ব্যাংকের সেবা দেওয়ার বিপরীতে বাড়তি কোনো মুনাফা পাবে না। এতে ব্যাংকের পরিচালনগত লোকসান হবে। এমন লোকসান দিয়ে আমদানির এলসি খোলার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা কঠিন হবে। আগে আমদানিতে ডলারের দাম ব্যাংকগুলো নিয়ন্ত্রণ করত। গড় কেনা দামের চেয়ে এক টাকা বেশি নিতে পারত।
এখন আমদানিতে ডলারের দামের সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেওয়ায় এক টাকা বেশি নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ব্যাংকগুলো এখন আন্তঃব্যাংকে ডলার বিক্রি না করে আগাম বিক্রি করছে। এ ক্ষেত্রে দামও বেশি। এক মাস মেয়াদি ডলার প্রায় ১১০ টাকা, দুই মাস মেয়াদি ১১০ টাকা ৫০ পয়সা, তিন মাস মেয়াদি ১১১ টাকা এবং ছয় মাস মেয়াদি ডলার বিক্রি হচ্ছে ১১৩ টাকা করে। কোনো কোনো ব্যাংক আরও বেশি দামে বিক্রি করছে। এভাবে ব্যাংকগুলো মেয়াদি ডলার কিনছে বেশি দামে। এতে খরচ বেশি পড়ছে। ফলে আমদানির দেনা শোধে এসব ডলার বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৪ জুলাই থেকে ডলারের দাম এক লাফে ২ টাকা ৮৫ পয়সা বাড়িয়েছে। তারা প্রতি ডলার ১০৬ টাকা করে আগে বিক্রি করত। ৪ জুলাই তা বাড়িয়ে ১০৮ টাকা ৮৫ পয়সা করে বিক্রি করেছে। এটিই ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে টাকার সবচেয়ে বড় অবমূল্যায়ন। আগে তারা ১ টাকা করে বাড়াত। আইএমএফ-এর শর্তের কারণে ডলারের একক দর প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দাম বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন তারা আন্তঃব্যাংকের ডলারের গড় দরের ভিত্তিতে রিজার্ভ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা বিক্রি করবে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলারের দামও বাড়বে। এতে আমদানিতে ডলার কেনার খরচও বাড়বে। ফলে অনেক ব্যাংকের পক্ষেই ১০৯ টাকা করে আমদানিতে ডলার বিক্রি করা সম্ভব হবে না।
এদিকে ব্যাংকগুলোয় নগদ ডলারের দাম ১১০ থেকে ১১২ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। আগে ছিল ১০৯ থেকে ১১০ টাকা। কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার ১১৩ থেকে ১১৪ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে।
মন্তব্য