শ্রেণিকক্ষ নেই, খোলা আকাশের নিচে পাঠদান

হবিগঞ্জের বাহুবলের বশীনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বর্ষা মৌসুমেও খোলা আকাশের নিচে পাঠদান করাচ্ছেন শিক্ষকরা। স্কুল চলাকালীন ঝড়-বৃষ্টি আসলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনেই আশ্রয় নেন। ১০ বছর আগে বিদ্যালয়ের একমাত্র ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হলেও নতুন ভবন কবে নির্মাণ হবে- তা কেউ বলতে পারছেন না। ফলে দিন দিন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। বাধ্য হয়ে এলাকার অনেক শিশুই কয়েক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পার্শ্ববর্তী বিদ্যালয় যাচ্ছে।

বাহুবল উপজেলার মিরপুর ইউনিয়নের ৮৬নং বশীনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ১৯৮৮ সালে ওই গ্রামের মরহুম মুক্তিযোদ্ধা নাজমুল হোসেনের বাবা মরহুম শামছুল হোসেনের দানকৃত ৩৩ শতক ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমদিকে এলাকাবাসীর প্রচেষ্টায় টিনের ছাউনি ও বাঁশের বেড়া দিয়ে একচালা একটি ঘর নির্মাণ করে ৬ বছর বিদ্যালয়টি পরিচালনা করা হয়। ১৯৯৪ সালে স্কুলটি রেজিস্ট্রেশন লাভ করলে এলজিডির তত্ত্বাবধানে সরকার ৪ লক্ষ ২০ হাজার টাকা ব্যয়ে ৪ কক্ষ বিশিষ্ট একতলা ভবন নির্মাণ করে। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান দায়সারা ভাবে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করার ফলে কিছুদিন যেতে না যেতেই ভবনের অনেকাংশে ফাটল দেখা দেয়।

এরপর দ্রুতই ভবনটির সিমেন্ট-বালি খসে পড়তে থাকে। একপর্যায়ে জরাজীর্ণ ভবনে শিশু শিক্ষার্থীদের ঝুঁকি নিয়ে পাঠদান করতে বাধ্য হন শিক্ষকরা। পরে বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে এলে ২০১২ সালে উপজেলা প্রকৌশলী অধিদপ্তর থেকে ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে শুরু হয় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের চরম দুর্ভোগ। আর এ দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে সমাপনী পরীক্ষায় ধারাবাহিক ভালো ফল অর্জন করায় ২০১৩ সালে বিদ্যালয়টিকে জাতীয়করণ করা হয়। জাতীয়করণের পর টানা তিন বছর বর্ষা মৌসুমে পার্শ্ববর্তী মক্তব ঘরে আর শুকনো মৌসুমে খোলা আকাশের নিচে শিক্ষার্থীদের বসিয়ে চলে পাঠদান কার্যক্রম।

২০১৫ সালে উপজেলা বার্ষিক উন্নয়ন খাত থেকে এক লাখ টাকা ব্যয়ে ৩০ ফুট লম্বা টিনসেডের একটি খোলা ছাউনি তৈরি করে দেওয়া হয়। কিন্তু ওই ছাউনির বেড়া না থাকায় বর্ষা মৌসুমে সেখানে পাঠদানের উপযোগিতা না থাকা সত্ত্বেও শিশুদের নিয়ে দৌড়ঝাঁপ, টানাহেঁচড়ার মধ্য দিয়ে বছরখানেক পাঠদান করান শিক্ষকরা। পরে ২০১৬ সালে এক কালবৈশাখী ঝড়ে টিনশেডটি লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। এরপর থেকে দীর্ঘ ৬ বছর ধরে চলছে খোলা আকাশের নিচে কোমলমতি শিশুদের পাঠদান কর্যক্রম।

পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র মাহিম মিয়া জানায়, প্রতিদিন বিদ্যালয়ে এসে আমাদের বেঞ্চ ও ডেস্ক ভবন থেকে বের করে বাইরে বসে ক্লাস করতে হয়। বিকালে আবার ওইগুলো ভবনের ভিতরে রেখে যেতে হয়। এতে প্রায়ই আমাদের দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়।

প্রধান শিক্ষক ফারুক আহাম্মদ জানান, এই স্কুলে বশীনাসহ পার্শ্ববর্তী দ্বিমুড়া ও আব্দুল্লাপুর গ্রামের শিশুরা শিক্ষা গ্রহণ করছে। বর্তমানে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ২৫০ জন ও কর্মরত শিক্ষক ৫ জন। পরিত্যক্ত ভবনেই দীর্ঘদিন যাবত ঝুঁকি নিয়ে অফিস কক্ষ ব্যবহার করতে হচ্ছে। এখন আর এই ভবনের কোনো অংশই ব্যবহার উপযোগী নয়। কখন কোন বড় দুর্ঘটনা ঘটে যায়। গত ২৬ জুন সকালে বজ্রসহ বৃষ্টিপাত শুরু হলে শিক্ষার্থীরা পরিত্যক্ত ভবনের একটি কক্ষে আশ্রয় নিলে এ সময় ছাদের বেশকিছু জায়গা থেকে ঢালাই খসে নিচে পড়ে যায়।

এ সময় অল্পের জন্য বড় ধরনের দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পায় শিক্ষার্থীরা। এই প্রতিকূল পরিবেশে পাঠদান করেও প্রতি বছরের মতো গত বছরও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় শতভাগ পাশের মাধ্যমে সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলেছি। ভবনের ব্যাপারে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে বারবার কর্তৃপক্ষের বরাবরে আবেদন করেও আজ পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো আশ্বাস পাচ্ছি না। ২০১৭ সালে উপজেলা প্রকৌশলী কার্যালয় থেকে একটি সয়েল টেস্ট ছাড়া আর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কর্তৃপক্ষ।

বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ইউনিয়ন ব্যাংকের স্থানীয় শাখা ব্যবস্থাপক মো. মোজাক্কির হোসেন বলেন, দেশে এত উন্নয়ন হওয়ার পরেও আমাদের স্কুলটির একটি ভবন নাই ভাবতে খুব কষ্ট লাগে। দীর্ঘদিন ধরে খোলা আকাশের নিচে ও পরিত্যাক্ত ভবনে পাঠদান কার্যক্রম চালানোর কারণে অনেক অভিভাকরা দুর্ঘটনার ভয়ে সন্তানদের বিদ্যালয়ে না পাঠিয়ে বাড়িতে প্রাইভেট শিক্ষক রেখে পড়ান। এছাড়া অনেক বিত্তবান ও মধ্যবিত্ত অভিভাবক সন্তানদের অন্যত্র নিয়ে ভর্তি করাচ্ছেন।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হাসান মোহাম্মদ জোনায়েদ বলেন, স্কুলটির অবস্থা খুবই করুণ। আমরা আপাদত শিশুদের নিরাপত্তার জন্য পার্শ্ববর্তী একটি বাড়িতে পাঠদানের ব্যবস্থা করছি এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এডুকেশন ইমার্জেন্সিতে যোগাযোগ করেছি; যাতে স্কুলে আলাদা একটি স্থাপনা তৈরি করা যায়। নতুন ভবন নির্মাণের ব্যাপারে তিনি বলেন, সার্বিক প্রচেষ্টা চলছে।