লেজার লাইটে পণ্যবাহী পরিবহণে চাঁদাবাজি

রাতের ঢাকায় বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজদের নৈরাজ্য চলছে। রীতিমতো পুলিশি স্টাইলে লেজার লাইট মেরে থামানো হয় পরিবহণ। এরপর সন্ত্রাসী স্টাইলে পণ্যবাহীসহ বিভিন্ন পরিবহণ চালকের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয় চাঁদার এসব চাঁদা বৈধ না অবৈধ, তা জানেন না পরিবহণসংশ্লিষ্টরা। তবে নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে তারা মুখ বুজে সহ্য করেন এই জুলুম। ঢাকার বাইরে থেকে আসা ট্রাকচালকরা বলছেন, রাজধানীর গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, ওয়ারী, দোলাইপাড় এলাকার অন্তত ১০-১২ স্থানে দিতে হয় চাঁদা। চাহিদামতো টাকা না দিলে আটকে দেওয়া হয় মালামাল। এসব পয়েন্টে সব মিলিয়ে একেকটি গাড়িতে অন্তত ১ হাজার টাকার বাড়তি চাঁদা গুনতে হয় তাদের। এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সড়কে চলছে চাঁদাবাজি।

বাংলাদেশ ট্রাক কাভার্ডভ্যান মালিক শ্রমিক নেতারা বলছেন, পণ্যবাহী গাড়ি থেকে চাঁদাবাজি বন্ধের ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের কাছে দৌড়ঝাঁপ করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার চাঁদাবাজির বিষয়ে তারা জানিয়েছেন। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছেন। এরপরও চাঁদাবাজি বন্ধ করা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মোতালেব রোববার সন্ধ্যায় যুগান্তরকে বলেন, লেজার লাইট মেরে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান আটকিয়ে চাঁদাবাজি বরদাশতযোগ্য অপরাধ নয়। শুধু এই চাঁদাবাজিই নয়, দেশের প্রতিটি সিটি করপোরেশনের এলাকা অতিক্রম করতে সিটি করপোরেশনের নামে টোল আদায় করা হয়। এসব টোল আদায় বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। এরপরও তা কার্যকর হচ্ছে না।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম) একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, চাঁদাবাজিসহ অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অবলম্বন করেছে। এ ধরনের চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে অতীতেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এখনো নজরদারি চলমান রয়েছে। তাছাড়া পরিবহণ চাঁদাবাজি বন্ধে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে পুলিশের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে। ট্রাকচালক জহিরুল ইসলাম রোববার বলেন, গত শুক্রবার রাত সোয়া ২টায় গাড়ি নিয়ে যাত্রাবাড়ীর চৌরাস্তায় পৌঁছেন তিনি। এ সময় গাড়িতে একজন লেজার লাইট মারেন। পুলিশ মনে করে গাড়ি একটু ধীরগতি করতেই এগিয়ে আসে দুজন। একজন লাঠি উঁচিয়ে বলল ট্রাক ব্রেক কর, ব্রেক কর বলছি। নইলে গ্লাসে একটা বারি দিব, গ্লাসটা গুঁড়া করে ফেলব। চালক বললেন, গাড়ি থামালাম। এরপর ১০০ টাকা ধরিয়ে দিলাম। তিনি বলেন, ওরা কারা, কেন টাকা চাইছে, জানতে চাইনি। কারণ এদের কাছে এক ধরনের ব্লেড থাকে। সেটা দিয়ে আঘাত করতে পারে। এছাড়া গাড়ি ভাঙচুর করলে তো বড় ক্ষতি হবে। বগুড়ার শিবগঞ্জের মহাস্থান হাট থেকে ১০ টন সবজি নিয়ে শনিবার রাতে ঢাকায় আসেন চালক আব্দুল জলিল। গাবতলী এলাকায় এ প্রতিবেদকের কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি জানান, মূলত সাভারের কালিয়াকৈর থেকে চাঁদাবাজিটা শুরু হয়। কাওরান বাজার পর্যন্ত পৌঁছাতে বেশ কয়েকটি স্থানে লেজার লাইট মেরে গাড়ি থামানো হয়। তাদের চাঁদা দিয়েই আমরা গাড়ি চালাচ্ছি। কোথাও সিটি করপোরেশনের ইজারাদারদের রসিদ দিয়ে টাকা নিয়েছে, আবার কোথাও রসিদ ছাড়া টাকা নেয়। কালিয়াকৈরে সাভার পৌরসভার ইজারাদারের লোক পরিচয় দিয়ে নেয় ১০০ টাকা। আমিনবাজারের লাঠিবাহিনী নেয় ২০০ টাকা। গাবতলী থেকে মিরপুর-১ নম্বর কাঁচাবাজারের দিকে প্রবেশ করলে ট্রাক থেকে গাবতলী টার্মিনালের ইজারাদারের পরিচয় দিয়ে নেয় ৫০ টাকা। মিরপুর-১ নম্বর কাঁচাবাজারে দেড়শ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হয়। এদিকে ফার্মগেট খেজুরবাগান এলাকায় ট্রাফিক পুলিশকেও চাঁদা দিতে হয়। আর কাওরান বাজারে পার্কিংয়ের নামে চাঁদা দিতে হয় ৮০০ টাকা। অপর একটি সূত্র জানায়, যাত্রাবাড়ীর স্বামীবাগ এলাকায় প্রতিদিন মধ্যরাতে রাতেই ট্রাক থামিয়ে চাঁদা তোলা হয়। ডেমরার স্টাফ কোয়ার্টারের আবদুল মজিদ মার্কেটের সামনের রাস্তা থেকে যানবাহনের চালকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় চলছে। ওই এলাকা থেকে গত ৩০ এপ্রিল র‌্যাব-১০ এর একটি দল হাতেনাতে তিন চাঁদাবাজকে গ্রেফতার করে। র‌্যাবের একটি সূত্র জানিয়েছে, ইজারাদারদের কতিপয় লোক তাদের সীমানার বাইরে সিটি টোল আদায়ের নামে বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে টাকা আদায় করছে।

এদিকে গত ২ আগস্ট র‌্যাব-১০ এর একটি দল যাত্রাবাড়ী ও ডেমরা এলাকায় পণ্যবাহী পরিবহণে চাঁদাবাজির সময় নাসির, তরিকুল, আলী হোসেন ও আবুল হোসেন নামে চার চাঁদাবাজকে গ্রেফতার করে। র‌্যাব-১০-এর সহকারী পরিচালক (অপস.) এনায়েত কবীর শোয়েব জানান, এরা বেশ কিছুদিন ধরে যাত্রাবাড়ী গোলচত্বরের আশপাশের বিভিন্ন রাস্তায় বিভিন্ন পরিবহণের চালক ও সহকারীকে ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায় করছিল। গত ১৪ আগস্ট র‌্যাব-১০ এর একটি দল রাজধানীর দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী দোলাইপাড় চৌরাস্তা অভিযান চালিয়ে রনি, লিটন ও সাকিব নামে তিন চাঁদাবাজকে গ্রেফতার করে। তাদের কাছ থেকে নগদ ৬৬০ টাকা জব্দ করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতাররা র‌্যাবকে জানায়, তারা বেশ কিছুদিন যাবৎ দোলাইপাড়সহ আশপাশের বিভিন্ন রাস্তায় ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, পিকআপ, ড্রাম ট্রাকসহ বিভিন্ন পরিবহণের চালক-হেলপারদের ভয়ভীতি দেখিয়ে অবৈধভাবে চাঁদা আদায় করে আসছিল।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্র জানিয়েছে, গত বছর পরিবহণ চাঁদাবাজদের ৬০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ বছরও বেশ কয়েকজন গ্রেফতার হয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় মামলা করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, পুরান ঢাকার আলুবাজারে প্রতি গাড়ি থেকে ৭০ থেকে দেড়শ টাকা নিচ্ছে চাঁদাবাজরা। বাবুবাজার ব্রিজের নিচে গাড়ি থেকে চাঁদা তোলা হয়। কোর্ট-কাছারি ফ্লাইওভারের নিচে এবং মিটফোর্ড ঘাটের সামনে গাড়ি থামিয়ে চাঁদা তোলা হয়। বংশাল থেকে তাঁতীবাজার পর্যন্ত বেশ কয়েকটি স্থানে গাড়ি থামিয়ে চাঁদা আদায় করা হয়। টাকা না দিলে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ চালকদের। চালকরা বলছেন, এসব এলাকায় কিছু চাঁদাবাজ আছে প্রভাবশালী। তাদের সঙ্গে কোনো কথা বলা যায় না। অভিযোগ রয়েছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন এলাকায় সিটি টোল আদায়ের নামে জোরজবরদস্তি করে বিভিন্ন পরিবহণের চালকদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অর্থ ও সংস্থাপনসংক্রান্ত স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি ৪২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. সেলিমে বলেন, আমরা বিভিন্ন বাস ও ট্রাক টার্মিনালে ইজারার অনুমোদন দিয়েছি। এর বাইরে কারও টোল আদায়ের অনুমতি নেই। ইজারাদারদের কেউ যদি চাঁদাবাজির মতো কাজ করে থাকে তবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া অন্য কেউ চাঁদাবাজির মতো অপরাধ করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।

টাকা।