দিনে রিকশাচালক হকার, রাতে দুর্ধর্ষ চোর

চক্রের সদস্য সংখ্যা ১১ জন। নেতৃত্ব দেয় মো. বাবু। চক্রের সদস্যরা দিনের বেলা কেউ রিকশা চালায়, ফেরি করে কাপড় বিক্রি করে। আবার কেউ দোকানে চাকরি করে। এসব পেশার আড়ালে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে তারা রেকি করে। পরে রাতের বেলা তারা নেমে পড়ে চুরিতে। এভাবে গত ১৫ বছর ধরে তারা স্বর্ণের দোকান, কাপড়ের দোকান, মুদির দোকান ও বিকাশের দোকানে চুরি করে আসছে। হাইড্রোলিক ভল্ট কাটার দিয়ে দোকানের শাটারের তালা এবং কেচি গেইটের তালা কেটে ভেতরে প্রবেশ করে তারা নিমিষেই সবকিছু লুট করে নিযতবে রেহাই মিলেনি। ১৭ই অক্টোবর বংশাল থানাধীন মাদ্রাসা মার্কেটে একটি দোকানে তালা কেটে দুর্ধর্ষ চুরির ঘটনার তদন্তের একপর্যায়ে ডিএমপি’র গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগ শনিবার চক্রের ৪ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। পরে তাদের দেয়া তথ্যমতে ১৫টি মোবাইল ফোন, ২টি তালা কাটার কাটার, ৪টি তালা, ১০টি চাবি, নাট-বল্টু, ২টি সেলাই রেঞ্জ, ৫টি স্ক্রু ডাইভার, সরঞ্জামাদি বহন করার ২টি ব্যাগ, নগদ ৭৮ হাজার টাকা, ২টি ছাতা, ১টি চাদর, ১টি ক্যাপ, ২টি হাতুরি, ১টি বড় কেচি, ২টি প্লাস উদ্ধার করা হগ্রেপ্তারকৃতরা হলো- চক্রের মূলহোতা মো. বাবু, আলমগীর হোসেন মালু, মো. রুবেল এবং মো. ইসহাক ওরফে সাগর। ঢাকা’র মাতুয়াইল, ডেমরা, নারায়ণগঞ্জ এবং কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।ডিবি লালবাগের তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দলনেতা বাবুর নেতৃত্বে এই গ্রুপে কাজ করে ১০ থেকে ১১ জন। চুরি করাই তাদের মূল পেশা। তবে দিনের বেলা তারা দৃশ্যমান কিছু পেশার সঙ্গে জড়িত। বাবুর সঙ্গে এই গ্রুপের অধিকাংশ সদস্যের ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে পরিচয়। তারা চট্টগ্রাম শহরের ফিশারিঘাট এলাকায় অনেক আগে থেকে মাছ চুরির সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়াও তারা চট্টগ্রাম এবং কুমিল্লা এলাকায় চুরি করে। চক্রে কিছুদিন পরে পরেই নতুন সদস্য সংগ্রহ করা হয়। গ্রেপ্তার মো. ইসহাক সাগর ৫/৬ মাস আগে এই গ্রুপে যোগ দেয়। ইসহাক ইজিবাইক চালানোর পাশাপাশি বিভিন্ন নাচের প্রোগ্রামে ড্যান্সার হিসেবে অংশগ্রহণ করতো। পরে এই চক্রের সদস্য তার আপন ভাই আকাশের মাধ্যমে এই চক্রে যোগ দেয়।

ডিবি জানায়, চোর চক্রটি হাইড্রোলিক ভল্ট কাটার দিয়ে দোকানের শাটারের তালা এবং কেচি গেইটের তালা কেটে ভেতরে প্রবেশ করে। বংশাল থানার ঘটনায় এভাবে তালা কেটে দোকানের ক্যাশবাক্সে রক্ষিত নগদ টাকা লুট করে নিয়ে যায়। চক্রের মূলহোতা বাবু ২ জনকে সঙ্গে নিয়ে এক সপ্তাহ আগে দোকানটি রেকি করে। চুরির ৩ দিন আগে চক্রের একজনকে পাঠায় দোকানটি পর্যবেক্ষণ করতে। ঘটনার দিন ৭/৮ জন চুরিতে সরাসরি অংশগ্রহণ করে। ২ জনের কাজ থাকে দূর থেকে পথচারীদের পর্যবেক্ষণ করা এবং প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে কথা বলে ব্যস্ত রাখা। দোকানের সামনে ২ জন একই কাজ করে পথচারীদের পর্যবেক্ষণ করে। দোকানের দুই পাশে দুই জন চাদর অথবা ছাতা ধরে থাকে। তখন একজন হাইড্রোলিক কাটার দিয়ে শাটার এবং কেচি গেইটের তালা কেটে একজনকে ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। দুই পাশে দুই জন চাদর বা ছাতা ধরে রাখে যাতে দুই পাশ থেকে দেখা না যায় ভেতরে কি হচ্ছে। চুরি শেষে কাটা তালা নিজের ব্যাগে ভরে নেয় এবং দোকানে নতুন তালা লাগিয়ে দেয়। কারণ কারও মনে যাতে সন্দেহ না জাগে যে সেখানে চুরি হচ্ছে বা হয়েছে।

তদন্ত কর্মকর্তারা বলেন, চক্রের সদস্যরা ২ মাস আগে ঢাকার মাতুয়াইল এবং ডেমরার কোনাপাড়া এলাকায় দুটি বাসা ভাড়া নেয় এবং মাতুয়াইলে মূলহোতা বাবুসহ আলমগীর হোসেন মালু এবং মো. রুবেলসহ ৩ জন এবং কোনাপাড়ার বাসায় সাগরসহ বাকি ৬ জন উঠে। চুরির কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রাদি ডেমরার কোনাপাড়ার বাসায় থাকতো এবং বাবু অপারেশনাল প্ল্যান করে সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতো। গ্রুপের প্রত্যেকেই নিজেদের মধ্যে ইমোতে যোগাযোগ রক্ষা করতো। 

ডিবি জানায়, গ্রুপটি এ পর্যন্ত ৪০-৫০টি চুরি করেছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে তথ্য দিয়েছে। তবে প্রকৃতপক্ষে তারা আরও অনেক বেশি চুরি করেছে। তাদের তথ্য অনুযায়ী এ ধরনের আরও ৫ থেকে ৬টি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। এরা স্বর্ণের দোকান, কাপড়ের দোকান, বিকাশের দোকান, ফল-ফ্রুটের দোকান ও হার্ডওয়্যারের দোকানে চুরি করে থাকে। চুরিকৃত অর্থ বা মালামালের ২০ শতাংশ আগে সরিয়ে ফেলে। এই ২০ শতাংশ অর্থ বা মালামাল দলনেতা বাবু, শরীফ, সুমন, শাহেদ এবং যারা দোকানের ভেতরে প্রবেশ করে তারা নেয়। বাকি ৮০ শতাংশ অর্থ বা মালামাল সবার মাঝে সমান ভাবে বণ্টন করা হয়।

ডিবি লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, চক্রের সদস্যরা চুরি বিদ্যায় পারদর্শী। তারা দীর্ঘদিন ধরে চুরি করছে। গত মাসে বংশাল এলাকার একটি চুরির ঘটনা তদন্ত করতে আমরা তাদের সন্ধান পেয়েছি। চুরি কাজে ব্যবহৃত বেশ কিছু সরঞ্জামও উদ্ধার করেছি। তিনি বলেন, আগে থেকে রেকি করে তারা চুরি করতে নামে। চক্রের একাধিক সদস্য অপারেশনাল কাজে নামলেও মূলত মূলহোতা বাবুর নির্দেশেই তারা কাজ করে। আমরা বাবুকেও গ্রেপ্তার করেছি। তারা আমাদেরকে জানিয়েছে, তাদের মতো আরও অনেক চক্র একইভাবে কাজ করে। তাদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।