এনজিও’র ঋণের বেড়াজালে বন্দি নিম্ন আয়ের মানুষ

নিজস্ব প্রতিনিধি:অভাব অনটন, বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কৃষির অনগ্রসরতা নানা কারণেই দরিদ্রতার ঘেরাটোপে প্রায়শই গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষ ক্ষুদ্রঋণের আশ্রয় নিতে হয়। নানা ধরনের প্রাকৃতিক দূর্যোগে নিম্ন আয়ের মানুষের এমনিতেই চুলো জ্বলছে না। এর ওপর বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) ও সমিতি থেকে নেওয়া ঋণের কিস্তি শোধের চাপে দিশেহারা মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন স্থানের নিম্ন আয়ের মানুষগুলো। ইতোমধ্যেই এনজিও ঋনের টাকা পরিশোধে অনেকে শেষ সম্বলটুকুও বিক্রি করে নিঃস্ব হচ্ছেন। এনজিও কর্মী অথবা সমিতির লোকজন বাড়িতে গিয়ে কিস্তি শোধের চাপ দিয়ে টাকা আদায় করতে না পেরে পুলিশী হয়রানীও করছেন। উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার গ্রাহকরা সময় মতো ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় এনজিও’র পক্ষ থেকে থানায় লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়েছে। অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশের হয়রানি ও ভয়ে গ্রাহকদের কেউ কেউ বাড়ি ছেলে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। জানা যায়, পুলিশের হয়রানিতে দিশেহারা কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগর ইউনিয়নের সতিঝিরগ্রাম এর রাবিয়া বেগম বলেন, “অভাবে পড়ে ব্র্যাকের সাপ্তাহিক কিস্তির টাকা দিতে না পারায় পুলিশ ফাঁড়িতে ডেকে নিয়ে আমার স্বামীকে আটকে রাখে। পরে কিস্তির টাকা দিয়ে স্বামীকে ছাড়িয়ে আনি। ব্র্যাকের কাছ থেকে ৩৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে স্বামীরে একটি রিক্সা কিনে দিলেও অভাব আর দুর্যোগের কারনে কিস্তির টাকা বকেয়া পড়ে। পরে ম্যানেজার থানায় অভিযোগ দেয়।” স্থানীয এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন সকাল হলেই ঋণের টাকার কিস্তির জন্য হাজির হয় এনজিও কর্মীরা। তাদের দেখলেই চমকে ওঠেন দরিদ্র মানুষ। বিভিন্ন এনজিওর ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে অভাবগ্রস্ত মানুষ এখন দিশেহারা। অনেক পরিবার একাধিক এনজিওর ঋণে জর্জরিত। একটির কিস্তি পরিশোধ করতে না করতেই অন্যটির টাকা জোগাড় করতে হয়। ফলে ঋণ গ্রহীতাদের দাদন ব্যবসায়ীর দ্বারস্থ হতে হয়। মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চহারে সুদ বা কমমূল্যে আগাম ফসল বিক্রি করে টাকা নিয়ে এনজিওর কিস্তি দিতে হয়। এমনিভাবে তাদের ঋণের বোঝা দিন দিন বেড়ে চলছে। এক ঋণ থেকে বাঁচতে অন্য ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েছে তারা। ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে গৃহবধূর স্বর্ণালঙ্কার, হালের পশু, ছাগল ও হাঁস-মুরগি বিক্রি করেও পার পাচ্ছে না অনেক পরিবার। শেষ সম্বল বাপ-দাদার বসতভিটাও বিক্রি করেছেন অনেকে। এনজিওর ঋণের চাপে সমবায় সমিতি ও দাদন ব্যবসায়ীদের ব্যবসাও এখন জমজমাট। অন্যদিকে ব্যাংকগুলোর কৃষিঋণ বিতরণে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা থাকলেও নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কারণে প্রকৃত কৃষকেরা ঋণ পান না বলে অভিযোগ রয়েছে। আরো জানা যায়, ব্র্যাক, আশা, গ্রামীণ ব্যাংক, টিএমএস, ব্যুরো বাংলাদেশ, পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন, আরডিআরএস বাংলাদেশ, মুসলিম এইড, সহ প্রায় ২২টি এনজিও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এদের মধ্যে বিভিন্ন নামে ১৫টি সংস্থা ঋণদান করছে। গ্রাম পর্যায়ে সমিতিসহ বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে ঋণ প্রদান করা হচ্ছে। ঋণ নিয়ে গ্রাহকরা সাপ্তাহিক কিস্তি পরিশোধ করার কথা। সপ্তাহে কিস্তি পরিশোধে অনেকেই ঘটিবাটি বিক্রি করে চলেছেন। তবে অভাব, অনটন, বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে কেউ কেউ কিছুদিন সাপ্তাহিক কিংবা মাসিক কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হন। ফলে দু’কিস্তি, ৩ কিস্তি, ৪ কিস্তি হারে টাকা বকেয়া হয়ে পড়ে। এনজিও কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কিস্তির টাকা আদায়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন করার পর থানায় লিখিত অভিযোগ দেয়। ফলে ঋণের চাপ, পুলিশের হয়রানি, আটক করে নেয়ার ভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ছেন গ্রাহকরা। কেউ কেউ বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ব্র্যাক কিস্তি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে দীর্ঘদিন থেকে থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়ে গ্রাহকদের পুলিশি হয়রানি করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি ব্র্যাকের শমশেরনগর শাখা ব্যবস্থাপকের পক্ষ থেকে ১০জন গ্রাহকের বিরুদ্ধে কমলগঞ্জ থানায় লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়। শমশেরনগর ইউনিয়নের সতিঝির গ্রামের শারমিন বেগম (ব্র্যাক বই নম্বর-১৯০), হাসনা বেগম, (বই নম্বর-১৬৫), সুলতানা বেগম অভিযোগ করে বলেন, অভাব অনটন, দুর্যোগ ও সমস্যায় পতিত হয়ে সময় মতো সাপ্তাহিক কিস্তি পরিশোধ করতে না পারায় ব্র্যাক ব্যবস্থাপক আমাদের বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছে। পুলিশ আমাদের হয়রানি করছে এবং টাকা না দিলে আটক করে নিয়ে যাবে বলে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। রঘুনাথপুর গ্রামের ফাতেমা বেগম বলেন, ব্র্যাকের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকার ঋণ নিয়ে সময় মতো কিস্তি দিতে না পেরে চক্রবৃদ্ধিতে সুদে আসলে পরিশোধ করতে পুলিশের তাড়া খেয়ে পালিয়ে আছি। রুনু বেগম (সদস্য নম্বর-১৬৮) বলেন, ব্র্যাকের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে প্রতিবন্ধী ভাই ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় কারণে কিস্তি পরিশোধ করতে না পারায় ব্যবস্থাপক থানায় অভিযোগ দিয়েছেন। পুলিশ কিস্তির জন্য হয়রানি করায় ভয়ে পালিয়ে আছি। অভিযোগ বিষয়ে ব্র্যাক শমশেরনগর শাখা ব্যবস্থাপক সাইদুর রহমান থানায় দেয়া অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, কিস্তি আদায় করতে না পেরে উর্দ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ করে থানায় লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়। অভিযোগের তদন্তকারী কর্মকর্তা কমলগঞ্জ থানার শমশেরনগর পুলিশ ফাঁড়ির এসআই শাহ আলম বলেন, ব্র্যাকের পক্ষ থেকে শমশেরনগর এলাকার ১০ জন গ্রাহকের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশেকুল হক বলেন, ক্ষুদ্র ঋণের জন্য কারো পক্ষ থেকে থানায় অভিযোগ দেয়া ঠিক নয়। এ ধরণের অভিযোগের বিষয়ে জানতে থানার ওসির সাথে কথা বলবো।