বুট ধার করে খেলা রনি যাচ্ছে স্বপ্নের ব্রাজিল

দরিদ্র পরিবারের সন্তান রনি মিয়া। ছোট থেকেই পাড়ার সাথীদের সঙ্গে ফুটবল খেলত। কিন্তু সংসারে অভাবের কারণে পিতাকে সহায়তা করতে স্বপ্নের ফুটবল খেলা ছেড়ে দিয়ে নদীতে বালু শ্রমিকের কাজ নিয়েছিল রনি।

ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে খেলতে যেত রনি। খেলায় যা পেত তা দিয়ে এক জোড়া বুটও কিনতে পারত না। তাই খালি পায়েই ফুটবল খেলত রনি মিঞা। মাঝে মধ্যে ফুফাতো ভাইয়ের বুট ধার করে খেলত। কিন্তু আকারে বড় হওয়ায় সেই বুটজোড়া পরে খেলতে গিয়েও দেখা দিত নানা বিপত্তি। চোটে পড়ে খেলা থেকে ছিটকে যেতে হয় রনিকে।

শুধু চোট নয়, ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখা রনির সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল দারিদ্র্যের দেয়ালও। কিন্তু সব বাধা জয় করে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর রনি। সেই স্বপ্ন পূরণের পথে হবিগঞ্জের ১৬ বছরের কিশোরের বড় একটা ধাপ উন্নত প্রশিক্ষণ নিতে ফুটবলের দেশ ব্রাজিলে যাওয়ার সুযোগ।

ঢাকায় নিযুক্ত ব্রাজিলের রাষ্ট্রদূত জোয়াও তাবাজারা দি অলিভিয়েরা জুনিয়রের সহযোগিতা ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের চেষ্টায় বাংলাদেশের চলতি বছর প্রশিক্ষণ নিতে ব্রাজিল যাচ্ছে বাংলাদেশের কিশোর ফুটবলারদের ১১ জনের একটা দল। সেই দলেরই একজন এই রনি।

সব ঠিক থাকলে আগামী মে মাসে ব্রাজিল যাবে ফুটবলাররা। বিকেএসপির চূড়ান্ত বাছাইয়ে ১১ জনের মধ্যে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার ৩ খেলোয়াড় আছেন। তারা হলেন রনি মিয়া, শংকর বাকতি ও অনিক দেববর্মা।

রনিদের পরিবারের অবস্থা নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো। বৃদ্ধ বাবা তৈয়ব আলী পাহাড় থেকে কাঠ কেটে বাজারে বেচতেন। সেই আয়ে কোনোরকম সংসার চলত। দুমুঠো ভাত না জুটলেও ফুটবল মাঠে মন পড়ে থাকত রনির। এভাবে খেলতে খেলতেই বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্কুল ফুটবলে খেলার সুযোগ হয়। সেখানে আলাদা করে সবার নজর কাড়ে রনি। এরপর সিলেট বিকেএসপিতে ট্রায়ালের পর সুযোগ মেলে সাভার বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার।

কিন্তু সেখানেও দেখা দেয় সমস্যা। বিকেএসপির নির্ধারিত মাসিক বেতন দিতে পারছিল না বলে পালিয়ে বাড়িতে ফিরে আসে রনি। ব্রাজিলে যাওয়ার সুযোগ পাওয়ার আনন্দে ভেসে যেতে যেতে সেই কষ্টের দিনগুলো বড় মনে পড়ছে রনির— ‘আমাদের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ। বাবার কাছে বিকেএসপির বেতনের টাকা চাইলে দিতে পারতেন না। তাই বিকেএসপি ছেড়ে চলে আসি।’

বিকেএসপি ছাড়ার পর বাবাকে সাহায্য করতে হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে শ্রমিকের কাজে নেমে পড়ে রনি। এলাকার নদী থেকে বালু তোলার কাজ করে বাবার হাতে সেই টাকা তুলে দিত— ‘ওই সময় কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। বাবার কষ্ট দেখে ভীষণ খারাপ লাগত। একপর্যায়ে বালু তোলার মেশিনের শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করি।’

কাজের ফাঁকে এলাকায় বিভিন্ন ফুটবল টুর্নামেন্টে নিয়মিত অংশ নিত রনি। তেমনই এক টুর্নামেন্টে রনির খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে নিজের ফুটবল একাডেমিতে ভর্তি করে নেন ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। কিন্তু ওই একাডেমিতে যেতেও আপত্তি ছিল রনির।

আর্থিক দুরবস্থার কারণ— ‘বড় ভাইকে বিদেশ পাঠাতে বাবা জমি বন্ধক রেখেছিলেন। সেই টাকা পরিশোধ করতে ভাই রাজমিস্ত্রির কাজ নেন। আমি বালু তুলতাম। ফুটবল খেললে বাড়তি কিছু পাব না, সেটা সুমন ভাইকে তখন জানিয়ে দিই। সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমাকে এক লাখ টাকার চেক দেন এবং একাডেমিতে ভর্তি করে নেন।’

বড় অঙ্কের টাকা পেয়ে বন্ধকি জমি ছাড়িয়ে নেয় রনি। এরপর নির্ভার হয়ে ব্যারিস্টার সুমনের একাডেমিতে খেলেছে তিন বছর। গত বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনূর্ধ্ব-১৭ গোল্ডকাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয় সিলেট বিভাগ। সেই দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফুটবলার ছিল রনি।

খেলে রাইটব্যাক পজিশনে। বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের বিভাগীয় দলে সুযোগ পেতে রনিকে পার হতে হয়েছে বেশ কয়েকটি ধাপ। শুরুতে ইউনিয়ন পর্যায়ের দলে খেলে রনি। সেখানে তার দল হারলেও ওই দল থেকে বাছাই করা খেলোয়াড়দের নিয়ে গঠন করা হয় থানা পর্যায়ের দল। একইভাবে থানার সেরা খেলোয়াড়দের সুযোগ মেলে জেলা পর্যায়ের দলে।

সর্বশেষে সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলার সেরা ফুটবলার নিয়ে গড়া হয় বিভাগীয় দল। এরপর দেশের ৮ বিভাগ থেকে সেরা ৪০ ফুটবলারের মধ্য থেকে বাছাই করে নেওয়া হয়েছে ব্রাজিল সফরের জন্য ১১ জনকে। সেই বাছাইয়ে টিকে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছে রনি।